×

মুক্তচিন্তা

ইফতার পার্টির রাজনীতি

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ মে ২০১৮, ০৭:২৯ পিএম

দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়াও সব রাজনৈতিক দলই চাইবে, ইফতারকে কেন্দ্র করে যে জনসম্মিলন হয়, তাকে নির্বাচনের প্রস্তুতির কাজে লাগাতে। বলার অপেক্ষা রাখে না, যে দল বা জোট নেগেটিভ বা নেতিবাচক বিষয়গুলোকে মোকাবেলা করে পজেটিভ বা ইতিবাচক দিকগুলোকে ‘ইফতার রাজনীতি’-এর ভেতর দিয়ে এগিয়ে রাখতে পারবে, সেই দল বা জোট ভোটের দৌড়ে স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে থাকবে।

রোজার মধ্যে ইফতার পার্টিকে কেন্দ্র করে রাজনীতি জমে উঠেছে। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর থেকে প্রতি বছরই ইফতার পার্টিকে কেন্দ্র করে রাজনীতি হয়। তবে একাদশ জাতীয় সংসদের আগে এটাই শেষ রোজা হওয়ায় ‘ইফতার রাজনীতি’ বা ‘রাজনৈতিক ইফতার’-এর গুরুত্ব আলাদা ধরনের। দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়াও সব রাজনৈতিক দলই চাইবে, ইফতারকে কেন্দ্র করে যে জনসম্মিলন হয়, তাকে নির্বাচনের প্রস্তুতির কাজে লাগাতে। বলার অপেক্ষা রাখে না, যে দল বা জোট নেগেটিভ বা নেতিবাচক বিষয়গুলোকে মোকাবেলা করে পজেটিভ বা ইতিবাচক দিকগুলোকে ‘ইফতার রাজনীতি’-এর ভেতর দিয়ে এগিয়ে রাখতে পারবে, সেই দল বা জোট ভোটের দৌড়ে স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে থাকবে।

‘ইফতার রাজনীতি’ এবারে শুরু করেছে বিএনপি আগে। দ্বিতীয় রোজায় প্রথমে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ইফতার পার্টিতে শামিল হয়েছে দলটি। এটাই ছিল স্বাভাবিক। কেননা বিএনপির সমস্যা হচ্ছে রাজনৈতিক এবং দলটি নির্বাচন সামনে রেখে এখন নতুন বন্ধু খুঁজতে ব্যস্ত। ২০ দলীয় জোটের পরিধি তারা বাড়াতে চাইবে। সহজেই ধারণা করা যায়, জামায়াত যতদিন পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে আছে ততদিন পর্যন্ত বামদলগুলো তাদের সঙ্গে নির্বাচনী জোটে বা আসন সমঝোতায় আসবে না। কিন্তু বয়কট করলে যাতে বিগত নির্বাচনের মতো সঙ্গে থাকে, তারা সেই চেষ্টা করবে। তবে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে বিকল্প ধারা, রবের নেতৃত্বে জেএসডি, কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বে নাগরিক ঐক্য, কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরামসহ অন্যান্য ছোট ছোট দলকে তারা জোটে না হোক অন্তত নির্বাচন করলে আসন সমঝোতা বা বয়কট করলে গতবারের মতো সঙ্গে রাখতে চাইবে।

সরকারি দল ও জোটকে যথাসম্ভব বেশিসংখ্যক রাজনৈতিক দল থেকে বিচ্ছিন্ন করাই হবে বিএনপির বর্তমান দিনগুলোর চাওয়া। এই চাওয়া থেকেই তারা উল্লিখিত ইফতার পার্টিটি প্রথমে করেছে। কামাল হোসেন ছাড়া উল্লিখিত নেতারা উপস্থিত থাকায় নিঃসন্দেহে তারা উল্লসিত হয়েছিল। কিন্তু ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী বাঁধিয়েছেন গোল। তিনি তার সাবেক নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি চাননি। বরং যা বলেছেন, তা বিএনপির বিপক্ষে গেছে। বিএনপি যখন গণআন্দোলন করতে চাইছে, তখন তিনি সত্য উদঘাটন করে বলেছেন, ‘নেতাদের বুক কাঁপে দুরু দুরু করে।’ তিনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে ‘ওটাও বলবে, ওটাও বলবে’ অর্থাৎ তৃতীয় শক্তি গড়ে তোলার কার্যত আহ্বান জানিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই এ কারণে বিএনপির লন্ডনের হাইকমান্ড বিকল্প ধারা প্রধানের প্রতি রুষ্ট হয়েছেন। উল্লেখ্য, বিএনপি এখন পড়েছে গর্তে। তাই এই সাবেক প্রেসিডেন্ট অতীতের দৌড়ানি খাওয়াটা মনে করে সুযোগ বুঝে বিএনপির ওপর বাক্যবাণে প্রতিশোধ নিতে চাইছেন কিনা কে জানে! ভবিষ্যৎ সেটা বলবে। তবে সার্বিক বিচারে বিএনপির প্রথম ইফতার পার্টিটি কেবল ফ্লপই হয়নি, উল্টো ফল দিয়েছে।

বিএনপি ইতোমধ্যে কূটনীতিকদের সম্মানেও ইফতার পার্টি করে ফেলেছে। নিঃসন্দেহে গুরুত্বের দিক থেকে দেশের ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর চাইতে বিএনপির কাছে এখন কূটনীতিকদের গুরুত্ব বেশি। এই কারণেই বিএনপি বিদেশিদের কাছে ধরনার রাজনীতি পূর্বাপর গুরুত্বের সঙ্গে চালু রেখেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাবশালী দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, ভারত ও পাকিস্তান। ওই সব দেশের কূটনীতিক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন গতবারই দৌড়ঝাঁপ করে বিএনপির বয়কটের পক্ষে কিছু করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র খুলনা সিটি করপোরেশন নিয়ে মুখ খুললেও এবং ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ কথা বারবার বললেও গতবারের অভিজ্ঞতায় দৌড়ঝাঁপ করবে বলে মনে হয় না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবারে এখনো পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে গতবাবের মতো মুখ খোলেনি, তেমন তৎপরতাও নেই। চীন কয়েকদিন আগে নির্বাচন নিয়ে কিছু বললেও শি জিনপিং-নরেন্দ্র মোদির অনানুষ্ঠানিক সাক্ষাতের পর থেকে এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে নীরব।

পাকিস্তান অবস্থান অপরিবর্তিত রেখে বিএনপি-জামায়াতের পক্ষেই থাকবে। এই দেশটি একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে সবসময়ই কাজ করে ভেতরে ভেতরে, ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের মাধ্যমে ঘুঁটি চালিয়ে। তবে ভারত ক্রমেই অবস্থান সুস্পষ্ট করছে। ইতোমধ্যে পূজা উদযাপন পরিষদের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী দুই দেশের সম্পর্কের যে ভিত তৈরি করে দিয়ে গেছেন, তার উচ্চ মূল্যায়ন করে বলেছেন, হাসিনা-মোদি সম্পর্ক আগামীতে আরো উঁচুতে উঠবে। ইতোমধ্যে জানা গেছে, হাসিনা-মোদি বহু প্রতীক্ষিত একান্ত বৈঠক হবে ২৫ মে শান্তি নিকেতনে। সেখানে দুই প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশ ভবন। শোনা যাচ্ছে সীমিত বছরের জন্য তিস্তা চুক্তি সেই বৈঠকে হতে পারে। নির্বাচন সামনে রেখে এ সব তৎপরতা নিঃসন্দেহে আগ্রহ উদ্দীপক। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, বিএনপি নেতা রিজভী মাঝে মাঝে ভারত বিরোধিতায় নামলেও অন্য প্রবীণ নেতারা এ বিষয়ে এবারে একটুও মুখ খুলছেন না। এটা কিসের ইঙ্গিত, তা অনুধাবন করতে অসুবিধা হয় না।

বিদেশিদের এ ধরনের অবস্থান ও তৎপরতা লক্ষ করে স্বাভাবিকভাবে তাই ওই ইফতার পার্টিতে ক‚টনীতিকদের সামনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘তবে আমরা বুঝি যে, আমাদের যে সংগ্রাম সেটা আমাদের নিজেদেরই সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে।’ এমনটা বললেও খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পরও আন্দোলনে বিএনপি নেতাদের ভূমিকা খালেদা জিয়া কথিত ‘আঙুল চোষাদের’ মতো। গত সোমবার ছিল নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সুচিকিৎসার দাবিতে সারা দেশে বিএনপির বিক্ষোভ মিছিল। কোনো কোনো পত্রিকায় ছোট করে দিবসটি পালনের খবর উঠেছে বিষয়টি বিবেচনায় নিলেই বোঝা যাবে, সংগ্রামের দৌড় বিএনপির কতটুকু! তাই বিএনপির অবস্থা এখন ‘মুখেন মারিতং জগৎ’ প্রবাদের মতো।

তবে ইফতার রাজনীতিতে সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে, চেয়ার খালি রেখে ইফতার পার্টি করা। দেশের রাজনীতির ইতিহাসে এই উদাহরণ অভিনব। এটা প্রমাণ করে, চেয়ারম্যানের শাস্তি হওয়া ও জেলে যাওয়ার পর ওই দায়িত্ব নেয়ার মতো ওই দলে উপযুক্ত কেউ দেশে নেই। কার্যকরী চেয়ারম্যানের দায়িত্বটাকে যেন নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। রামায়ণের রামের মতো চেয়ার খালি রাখার সংস্কৃতি বিএনপি চালু না করলেও পারত! কেননা তাতে দেশের মানুষ ও বিদেশিদের মনে পড়বে হাওয়া ভবন ও খোয়াব ভবন খ্যাত তারেক জিয়ার নাম, যা সহানুভূতি ও সমর্থন কুড়ানোর জন্য মোটেই অনুকূল নয়।

সর্বোপরি বিএনপি দল বা জোটের প্রধান ইস্যু নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি ইফতার রাজনীতির মধ্য দিয়ে সামনে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিএনপির জন্ম ও অতীত কর্মকাণ্ড বিশেষত প্রতিষ্ঠাতা সামরিক কর্তা জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখল ও হুকুমের নির্বাচন আর সেই সঙ্গে ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ‘টু ইন ওয়ান’ ইয়াজউদ্দিন সরকার ও হাওয়া ভবন সামনে রেখে বিএনপি যে ধরনের ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করার পাঁয়তারা করেছিল, তাতে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া কখনো ‘গণতন্ত্রের মা’ হতে পারবেন না। আসলে দলের দুই প্রধান নেতার দুর্নীতির দায়ে শাস্তি হওয়ায় নেতৃত্বশূন্য অবস্থায় সব দিক থেকে নতুন করে শুরু করতে হবে বিএনপিকে। যেমন হত্যা ও ক্যুয়ের রাজনীতিতে নেতৃত্বশূন্য হয়ে আওয়ামী লীগ শুরু করেছিল ১৯৮১ সালে, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে। বিএনপি আসলে নতুন করে কিছুই শুরু করতে পারছে না। তাই অক্টোপাসের জালে ক্রমেই জড়িয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের মাত্র ৭ মাস বাকি। কয়েকদিন পর দিন গণনা শুরু হবে। তবুও আন্দোলন বা নির্বাচন- এ দুটোর কোনোটাই স্পষ্ট নয় বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কাছে। এটা সুস্পষ্ট করা ভিন্ন বিএনপির কোনো পথ আর এখন নেই। প্রকৃত বিচারে ইফতার রাজনীতি শুরুতেই দেখিয়ে দিচ্ছে, বিএনপি নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছে।

এবার আওয়ামী লীগের দিকে চোখ ফেরানো যাক। ইতোমধ্যে ২১ মে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ইফতার পার্টি শুরু করছে আওয়ামী লীগ। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে শুরু করাটা আসলে বলে দিচ্ছে, এবারের নির্বাচনে উন্নয়নের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ হবে আওয়ামী লীগের প্রধান ইস্যু। নিবন্ধনবিহীন হয়েও জামায়াত যতদিন বিএনপির সঙ্গে আছে এবং বিএনপি যতক্ষণ রাজনীতিতে ধর্মকে অপব্যবহার করবে, ততদিনই জাগরুক থাকবে মুক্তিযুদ্ধ ইস্যু। আরো একটি ইস্যু রোজার শুরুতে আওয়ামী লীগ খুব সুকৌশলী হয়েই সামনে নিয়ে এসেছে। আর তা হচ্ছে জঙ্গি নির্মূল বা সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের মতো মাদকবিরোধী যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। প্রকৃত বিচারে আওয়ামী লীগের সমস্যা রাজনীতি নয়। মূল সমস্যা হচ্ছে দুটো- সংগঠন ও প্রচার। জানা যাচ্ছে ইফতার রাজনীতির ভেতর দিয়ে আওয়ামী লীগ অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দ্বন্দ্ব ও নেতাকর্মীদের মধ্যে দূরত্ব কমানোর এবং উন্নয়ন ও সাফল্য জনগণের সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করবে।

প্রসঙ্গত খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন দেখিয়ে দিয়ে গেছে, কোন্দল নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এবং উন্নয়ন ও সাফল্য যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারলে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে ঠেকানো অসম্ভব। কে জানে কতটুকু পারবে আওয়ামী লীগ? ইতোমধ্যে পত্রিকা পাঠে জানা যায়, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীকে নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রত্যাহার করার জন্য কেন্দ্রের কাছে সুপারিশ করেছে শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগ। তা ছাড়া জেলা কমিটি শেরপুর-৩ আসনের সাংসদ ফজলুল হকসহ ৫ জনকে জেলা কমিটি থেকে বহিষ্কার এবং নালিতাবাড়ি উপজেলা কমিটিকে বিলুপ্ত করেছে।

উপরের খবরটি দেখলেই বোঝা যায়, আওয়ামী লীগের তৃণমূলে কোন্দল ও দ্বন্দ্ব কতটা ব্যাপক ও তীব্র। বাংলাদেশের ইতিহাসে মতিয়া চৌধুরীর মতো সফল কৃষিমন্ত্রী আর কেউ নেই। অর্জন ও সাফল্যের দিক থেকে মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় আছে সব থেকে এগিয়ে। সততা, দক্ষতা, সংগ্রামী ঐতিহ্য ও মনোভাব এবং দল ও নেত্রীর প্রতি আনুগত্যে মতিয়া চৌধুরীর জুরি মেলা ভার। ১/১১ জরুরি আইনের সরকার যখন ‘মাইনাস টু’ নীতি নিয়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে আসতে বাধা দেয় এবং পরে গ্রেপ্তার করে, তখন তিনি ছিলেন রাস্তায় সবার সামনে। নির্বাচন সামনে রেখে মতিয়া চৌধুরীকেই যদি স্থানীয় দল ‘সাইজ আপ’ করতে নামে, তবে খুলনার মতো সব জায়গায় দলীয় ঐক্য ও সংহতি থাকবে বলে মনে করা বেশ কষ্টকর।

আর উন্নয়ন ও সাফল্যের প্রচারে আওয়ামী লীগ সব সময়েই থাকে পিছিয়ে। অভিজ্ঞতা বলে, ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে সংগঠন ও প্রচারের কাজ কমে যায়। মানুষ বলে, তখন ‘ধান্ধায় নামে’ নেতাকর্মীরা। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে প্রতিকূল বিশ্ব পরিস্থিতিতে সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধু-সরকার নতুন রাষ্ট্রকে স্থায়ী ও নতুন করে রূপ দিতে যে সব বহুমুখী কাজ ও সাফল্য অর্জন করেছিল, তা ভাবলে এখন বিস্মিত হতে হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কথিত ‘চাটার দলের’ অপকর্ম ও দুষ্কর্মের জন্য অপপ্রচার ও মিথ্যা প্রচারের জবাব দিয়ে সেই সব অর্জন ও সাফল্য সামনে আনা সম্ভব হয়নি। বাসন্তীর ‘জাল পড়া’ ছবি আর ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’-এর গল্প দেশি-বিদেশি মিডিয়াকে মাত করে রেখেছিল। এখনো অনেকটাই সেই ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এজন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দুঃখ ও ক্ষোভ নিয়ে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলতে হচ্ছে, ‘কেবল সমালোচনা নয় সাফল্য তুলে ধরুন।’ কিংবা বিদেশে ‘দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে মিডিয়ার সব সময় ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন’।

নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের আর একটা সমস্যা হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট। সিয়াম সাধনার মাসে ইফতার পার্টির মধ্য দিয়ে এই দিকটাতেও আওয়ামী লীগের দৃষ্টি নিক্ষেপ প্রয়োজন। সর্বোপরি নির্বাচনের আগে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে অক্টোবরে। অবস্থা পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে, সঙ্গত কারণেই বিগত ১০ বছরে ক্ষমতায় থাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। তারা সেই পাকিস্তানি আমলের মতো মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যবাহী দল ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও নিজেদের সংখ্যালঘুই ভাবছেন। আর সেই দিকটি লক্ষ্য করেই পূজা উদযাপন পরিষদের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক ওবায়েদুল কাদেরকে বলতে হয়েছে, ‘ছোটখাটো ভুল নিয়ে বসে থাকলে বড় ভুলত্রুটি হবে।’ ‘আওয়ামী লীগের বিকল্প নেই’ মন্তব্য করে ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী ‘পাকিস্তানি দোসরদের’ তাণ্ডবের বীভৎস কাহিনী তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সহজেই ধারণা করা যায়, সংখ্যালঘু জনগণের মন পরিবর্তনের কাজ আওয়ামী লীগকে চালিয়ে যেতে হবে। বলাই বাহুল্য, কেবল নির্বাচনে ভোট পাওয়ার জন্য নয়, আওয়ামী লীগের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও ঐতিহ্য সুরক্ষা ও ঊর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য এটা আজ একান্ত প্রয়োজন।

জুন মাস সমাগত। এই মাস কেবল আওয়ামী লীগের জন্মের মাসই নয়, ৭ জুনের রক্তস্নাত স্মৃতিবিজড়িত দেশের ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনেরও মাস। সাংবাদিকদের সামনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের প্রতি দৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাস রেখে বলেছেন, ‘জনগণ ভোট দিলে আছি, না দিলে নাই।’ পবিত্র রমজান শুরুর দিনে এই কথাটার মূল্য অপরিসীম। যদি এই কথাটি অনুধাবন করে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সব নেতাকর্মী জনগণের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে বলতে এবং কার্যে পরিণত করার শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করতে পারে, তবে দেশ-জনগণ ও গণতন্ত্রের জন্য জাতির আগামী দিনগুলো শুভ ও কল্যাণকর হবে বলেই বিশ্বাস।

শেখর দত্ত : রাজনীতিক, কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App