×

মুক্তচিন্তা

স্বশাসিত গণতান্ত্রিক জেলা সরকার সময়ের দাবি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ মে ২০১৮, ০৬:২৯ পিএম

দেশের স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী ও বিশিষ্টজনদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা সরকারের রূপরেখাটি পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা যেতে পারে। অর্থ, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও বৈদেশিক বাণিজ্যের মতো কিছু বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রেখে বাকি কাজগুলো জেলা সরকারের হাতে ছেড়ে দেয়াই হবে যুক্তিযুক্ত।

একটি দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য স্বশাসিত ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের বিকল্প নেই। জনগণের প্রকৃত অংশ নেয়া ছাড়া যে দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, শিল্প, পরিবেশ সংরক্ষণসহ কাক্সিক্ষত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব নয়- এটা বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ এক বাক্যে স্বীকার করেন। এ বিষয়ে আমাদের সংবিধানের ৩য় পরিচ্ছেদের ৫৯ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হবে। আরো উল্লেখ আছে- এই সংবিধানের ও অন্য কোনো আইন সাপেক্ষে সংসদ আইনের দ্বারা যেরূপ নির্দিষ্ট করিবেন, এই অনুচ্ছেদের (১) দফায় উল্লিখিত অনুরূপ প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান যথোপযুক্ত প্রশাসনিক একাংশের মধ্যে সেরূপ দায়িত্ব পালন করিবেন। এ ছাড়া এই সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদের বিধানাবিলকে পূর্ণ কার্যকারিতাদানের উদ্দেশে সংসদ আইনের দ্বারা উক্ত অনুচ্ছেদে উল্লিখিত স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহকে স্থানীয় প্রয়োজনে কর আরোপ করিবার ক্ষমতাসহ বাজেট প্রস্তুতকরণ ও নিজস্ব তহবিল রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষমতা প্রদান করিবেন।

২০০৩ সালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ‘জেলায় জেলায় সরকার’ নামে একটি বই প্রকাশ করে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের কথা উল্লেখ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একাধিকবার ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের জন্য অনুরূপ ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশ নেয়া নিশ্চিত করার লক্ষে জেলা প্রশাসনিক কাউন্সিল ও জেলা গভর্নর পদ্ধতি প্রবর্তন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ওই পদ্ধতিতে খাদ্য, শিক্ষা, শিল্প, স্বাস্থ্য, কৃষি, সেচ, পরিবার পরিকল্পনা ও আইনশৃঙ্খলাসহ জেলার সব কর্মকাণ্ড জেলা গভর্নরের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল জেলা প্রশাসনিক ইউনিট সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে কাজ করার।

বহুদিন ধরেই আমরা বাংলাদেশে দুধরনের সরকারের কথা বলে আসছি। একটি কেন্দ্রীয় সরকার এবং অন্যটি স্বশাসিত, স্বনির্ভর ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার। এ জন্য সর্বপ্রথম স্থানীয় সরকারের স্তর বিন্যাস হওয়া প্রয়োজন। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন স্তর নির্ধারণ করা দরকার। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্যও থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে বর্তমানে তিন ধরনের স্থানীয় সরকার রয়েছে। এক. শুধু গ্রামীণ এলাকা নিয়ে গঠিত গ্রামীণ স্থানীয় সরকার, যেমন ইউনিয়ন পরিষদ। দুই. গ্রামীণ নগরীয় স্থানীয় সরকার : গ্রাম ও নগর এলাকা নিয়ে গঠিত স্থানীয় সরকার। যেমন : উপজেলা ও জেলা পরিষদ। তিন. নগরীয় স্থানীয় সরকার : শুধু নগরীয় এলাকা নিয়ে গঠিত স্থানীয় সরকার। যেমন, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন। বিদ্যমান স্থানীয় সরকারগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। তাদের কোনো স্বশাসন সেই। নেই স্বাধীনভাবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার মতো কোনো আয়ের উৎস। স্থানীয় সরকারের সব কাজের জন্য তাদের কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর নির্ভর করতে হয়। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদসহ বেশকিছু রাজনীতিবিদ বাংলাদেশকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করলেও আমরা এ মুহূর্তে এ ব্যাপারে তাদের সঙ্গে সহমত পোষণ করি না। কারণ বাংলাদেশে প্রদেশ গঠন করার মতো পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি হয়নি এবং সে সামর্থ্য ও দেশটির নেই।

দেশের সব মহল থেকে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন, স্বশাসন ও গণতন্ত্রায়নের কথা বার বার উচ্চারিত হলেও এ পর্যন্ত সেন্টার ফর ডেমেক্র্যাটিক লোকাল গভর্নেন্স (সিডিএলজি) ছাড়া কোনো মহল থেকেই গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়নি। ১৯৯৭ সালের ১৩ জানুয়ারি, সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার গবেষক আবু তালেব গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখাটি ঢাকার জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘স্বশাসিত স্থানীয় সরকার : গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত’ শীর্ষক এক জাতীয় সেমিনারে তৎকালীন সরকারের গঠিত ‘স্থানীয় সরকার কমিশন’ ও অন্য সবার অবগতি ও বিবেচনার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করেন। ওই রূপরেখায় নগর সরকার, নগরীয় কৃষি এবং পরিকল্পিত নগরায়ন ও সবুজায়নের কথাও বলা আছে।

বাংলাদেশে ইউনিয়ন, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনকে সর্বনিম্ন এবং জেলাকে স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ স্তর হিসেবে নির্ধারণ করা উচিত। জেলা এক হাতে গ্রামীণ স্থানীয় সরকারগুলো ও অন্য হাতে নগরীয় স্থানীয় সরকারগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে এবং জেলা সরকারের কাজ হবে প্রাদেশিক সরকারের মতো। অন্যদিকে স্থানীয় সরকারের প্রত্যেকটি ইউনিটের সঙ্গে সরকার শব্দটি যুক্ত করে সেগুলোকে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিতে হবে। যেমন ইউনিয়নে ইউনিয়ন সরকার, উপজেলায় উপজেলা সরকার, জেলায় জেলা সরকার এবং পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে একরূপ নগর সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জেলা বিধানিক বিভাগ (জেলা সংসদ), জেলা নির্বাহী বিভাগ ও জেলা বিচারিক বিভাগের সমন্বয়ে স্বশাসিত ও গণতান্ত্রিক জেলা সরকার গঠন করতে হবে। জেলা সরকারের মেয়াদ হবে ৪ বছর। জেলা সংসদ হবে জেলার সব কর্মকাণ্ডের গণতান্ত্রিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র বিন্দু। জেলা সংসদে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ জেলা নির্বাহী বিভাগ বাস্তবায়ন করবে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে জেলাকে কতগুলো নির্বাচনী এলাকায় বিভক্ত করতে হবে। প্রতিটি নির্বাচনী এলাকা থেকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী সদস্য জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন এবং তাদের সমন্বয়েই জেলা সংসদ গঠিত হবে। জেলা সংসদের সভাপতি জেলা সাংসদদের ভোটে তাদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন। জেলা চেয়ারম্যান ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। তিনি বিচারিক ও নির্বাচনিক দায়িত্ব ছাড়া আর সব দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি একাধারে জেলার, জেলা সরকারের ও জেলা নির্বাহী বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করবেন। মিলেনিয়াম প্রপোজাল পার্ট ওয়ানের আলোকে প্রতিটি জেলায় একজন নারী ভাইস চেয়ারম্যান ও একজন পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচন করতে হবে। জেলা বিচারিক বিভাগ প্রশাসনিক ও বিধানিক বিভাগ থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা থাকবে। প্রয়োজনে দেশের স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী ও বিশিষ্টজনদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা সরকারের রূপরেখাটি পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা যেতে পারে। বাংলাদেশের মতো ১৬ কোটি মানুষের একটি সমস্যা সঙ্কুল দেশ এ ধরনের এককেন্দ্রিক দূরবর্তী সরকার ব্যবস্থার দ্বারা সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে না। তাই অর্থ, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও বৈদেশিক বাণিজ্যের মতো কিছু বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রেখে বাকি কাজগুলো জেলা সরকারের হাতে ছেড়ে দেয়াই হবে যুক্তিযুক্ত। এতে সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জনগণের অংশ নেয়া নিশ্চিত হবে।

নিতাই চন্দ্র রায় : কৃষিবিদ ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App