×

মুক্তচিন্তা

ইফতার : নিরন্ন মুখে হাসির ঝিলিক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ মে ২০১৮, ০৬:০৯ পিএম

মাহে রমজানের ইফতার হচ্ছে ইসলামি সংস্কৃতির একটি উজ্জ্বলতর অংশ। কাউকে ইফতার করানো অশেষ ফজিলত ও পুণ্যময় একটি ইসলামি নির্দেশনা হলেও আজ দেশে যে ধরনের ইফতার সংস্কৃতি চালু হয়েছে তা ইফতারের মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। যাদের আর্থিক সঙ্গতি আছে, যারা সচ্ছল শুধুমাত্র তাদের নিয়ে ইফতারের আয়োজন মানে তৈলাক্ত মাথায় তেল দেয়ার শামিল। বরং ইফতার মাহ্ফিল যদি করতেই হয় দরিদ্র অভাবী লোকদের নিয়ে করতে হবে।

মাহে রমজানের বড় উপলক্ষ হচ্ছে দিনব্যাপী সিয়াম সাধনা শেষে সন্ধ্যায় সানন্দে ইফতার গ্রহণ। ধনী গরিব সবাই ইফতারের আনন্দে শামিল হয়। দিন শেষে রোজাদারের শুষ্ক নিরন্ন মুখে হাসি ফোটায় ইফতার। সূর্যাস্তের পর রোজাদারের রোজা ভঙ্গের যত আনন্দ ও উৎসব এই ইফতার ঘিরে। ইফতার শব্দের অর্থ বিরতি, ভঙ্গ করা। ইসলামি পরিভাষায় পশ্চিমাকাশে সূর্য অস্ত যাওয়ার পর রোজা সমাপ্তির জন্য সান্ধ্যআহার গ্রহণই ইফতার। রোজা রেখে সময়মতো ইফতার করা ও অন্যকে ইফতার করানোয় রয়েছে অশেষ সওয়াব ও কল্যাণ। প্রিয়নবী (দ.) বলেছেন, রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ মুহূর্ত রয়েছে। এর একটি হলো, তার ইফতারের সময় আর অন্যটি হল আল্লাহ্র সঙ্গে তার নিশ্চিত সাক্ষাত লাভের খুশি। (বুখারী ও মুসলিম)।

ইফতার সূর্যাস্তের পরপরই করা উত্তম। অন্ধকার হওয়ার জন্য অপেক্ষায় থেকে দেরিতে ইফতার করা ঠিক নয়, মাকরূহ (আল্লাহ্র কাছে অপছন্দনীয়)। প্রিয়নবী (দ.) সাহ্রি দেরিতে খাওয়া এবং ইফতার সূর্যাস্তের সঙ্গে দ্রুত সেরে ফেলার সুস্পষ্ট তাগিদ দিয়েছেন। আল্লাহ্র রাসূল (দ.) বলেন, ‘তোমরা ইফতারের সময় হলেই দ্রুত ইফতার করে নাও, বিলম্বে ইফতার করো না।’ ইফতার সঠিক সময়ে করার নির্দেশনা দিয়ে প্রিয়নবী (দ) বলেন, ‘ততদিন পর্যন্ত মানুষ কল্যাণের মধ্যে থাকবে, যত দিন তারা ইফতারের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত ইফতার করে নেবে।’ (বুখারি ও মুসলিম শরিফে হাদিসটির বর্ণনা রয়েছে)। তবে সূর্যাস্ত হয়েছে কি-না এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সংশয় থাকলে ধারণার ওপর ইফতার করা যাবে না। সময়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে দেরি না করে তাড়াতাড়ি ইফতারি করাই ইসলামের হুকুম। আল্লাহ্ কাছে এটাই উত্তম আমল হিসেবে গণ্য। হাদিসে কুদসীতে মহান আল্লাহ্ পাক বলেন, আমার বান্দাহদের মধ্যে যারা সঠিক সময়ে ইফতার করে, তারাই আমার কাছে অধিকতর প্রিয়। নবী করিম (দ.)-এর বাণীতেও দ্রুত ইফতার করার ফজিলত ব্যক্ত হয়েছে। নবীজী (দ.) বলেন, ‘আমি ওই লোককে বেশি ভালবাসি যে ইফতারের সময় হওয়া মাত্র দেরি না করে দ্রুত ইফতার করে নেয়’। (তিরমিজি হাদিসগ্রন্থে এ বর্ণনা রয়েছে)।

হালাল জীবিকায়, বৈধ উপার্জনে ইফতারের ব্যবস্থা হওয়া উচিত। হালাল দ্রব্যও ইফতারের জন্য পূর্বশর্ত। খুরমা বা খেজুর দিয়ে ইফতার করা সুন্নাত। তা না থাকলে বিশুদ্ধ পানীয় দিয়ে ইফতার সেরে নেয়া ভাল। অথবা শরবত বা যে কোনো মিষ্টি দ্রব্য দিয়ে ইফতার করা হলে সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে। হযরত সালমা (রা) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবী করিম (দ) বলেন, “তোমাদের কেউ যখন রোজা রেখে ইফতার করে, তখন খুরমা-খেজুর দিয়ে যেন ইফতার করে নেয়। কেননা, এতে বরকত রয়েছে। যদি খুরমা-খেজুর না পায়, তবে পানি দিয়ে ইফতার করবে। কারণ, পানি হল পবিত্র, পাক পবিত্রকারী।” রোজাদারকে ইফতার করানোর নির্দেশনাও রয়েছে মহানবীর (দ) বাণীতে। এতে রোজার মাহাত্ম্য ও ফজিলত অর্জিত হয়। প্রিয় নবী (দ) ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি হালাল খাদ্য বা পানীয় দ্বারা কোন রোজাদারকে ইফতার করায়, ফেরেশতারা তার কল্যাণের জন্য মাহে রমজানে তার জন্য দু’আ করেন। জিব্রাইল (আ) তার জন্য শবে কদরে ইস্তেগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করেন।” ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে আল্লাহ্পাক বান্দাহর ওপর খুবই প্রসন্ন হন, অঝোর ধারায় রহমত ও করুণা বর্ষণ করেন রোজাদারের ওপর। বান্দাহর প্রতি খুশি হয়ে রোজার উসিলায় গুনাহসমূহ মার্জনা করেন মহান আলল্লাহ্পাক। ইফতারির মধ্যে দিয়ে আত্মিক প্রশান্তি আসে, দেহ মনে এনে দেয় স্বস্তি-আনন্দ, আধ্যাত্মিক চেতনা শাণিত হয় রোজাদারের। রোজাদারের মাঝে পরম তৃপ্তি ও সুখানুভূতি সৃষ্টি হয় ইফতারের মধ্যদিয়ে। আবু দাউদ শরিফে বর্ণিত হাদিস রয়েছে, প্রিয়নবী (দ.) যখন ইফতার করতেন, তখন বলতেন আমার তৃষ্ণা মিটেছে, আমার শিরা-উপশিরা সিক্ত হয়েছে এবং আল্লাহ্পাকের পুরস্কার নির্ধারিত হয়ে গেছে। রোজাদারকে ইফতার করানোর প্রতি উৎসাহিত করে নবীজী (দ) বলেন, “যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তা তার জন্য পাপসমূহ মার্জনা ও জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতির উসিলা হবে এবং সেও রোজাদারের সমান সওয়াব বা পুণ্যের অংশীদার হবে। উভয়ের সওয়াবের মধ্যে কোনো কম দেওয়া হবে না।” সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমরাও এ সাওয়াবের অংশীদার হতে চাই। অথচ সেই সামর্থ্য তো আমরা রাখি না। তখন আমরা কী করব হে আল্লাহ্র রাসূল (দ)! উম্মতের করুণাধারা নবীজী (দ) প্রত্যুত্তরে বললেন, এই সাওয়াব সেও পাবেন, যে রোজাদারকে এক ঢোক পানি, একটি খেজুর বা এক চুমুক দুধ পান করাবেন। আল্লাহ্ পাক এ ধরনের অতিথিবৎসল লোককে হাউজে কাউসারের এমন পানি পান করাবেন, যার পর জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত সে আর পিপাসার্ত হবে না। (হাদিসগ্রন্থ বায়হাকিতে বর্ণনাটি রয়েছে)।

অতীব দুঃখজনক যে, মাহে রমজানের ইফতার হচ্ছে ইসলামি সংস্কৃতির একটি উজ্জ্বলতর অংশ। কাউকে ইফতার করানো অশেষ ফজিলত ও পুণ্যময় একটি ইসলামি নির্দেশনা হলেও আজ দেশে যে ধরনের ইফতার সংস্কৃতি চালু হয়েছে তা ইফতারের মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। যাদের আর্থিক সংগতি আছে, যারা সচ্ছল শুধুমাত্র তাদেরকে নিয়ে ইফতারের আয়োজন মানে তৈলাক্ত মাথায় তেল দেওয়ার শামিল। বরং ইফতার মাহ্ফিল যদি করতেই হয় দরিদ্র অভাবী লোকদের নিয়ে করতে হবে। কোনো ধরনের বাছ-বিচার না করে গরিবের অবাধ অংশগ্রহণে ইফতার মাহফিল আয়োজন হওয়া চাই। আমাদের দেশে ধনীদের মধ্যে যে ইফতারের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তাতে রোজার সংযমের শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত ও ব্যতিক্রমী চিত্র ফুটে ওঠে। অনেক পদের, ২০/৩০ টি মুখরোচক দামি খাবার না হলে ইফতার পার্টি যেন জমে না। এমনও দেখা যায়, ইফতারের বাহারি স্তুপ থেকে কিছু কিছু খেয়ে বাকিটুকু উচ্ছিষ্ট করে ফেলে দেয়া হয়। অথচ উনারা তখন ভেবে দেখেন না কোটি রোজাদারের মুখে ইফতারের সময় অল্প ছোলা একটি খেজুরও জুটে না এই গরিব দেশে। এখানে কি-না ইফতারির নামে চলে ঢালাও আয়োজন, প্রচুর অপচয়। এটা রোজার শিক্ষা হতে পারে না। ইফতার অনুষ্ঠানে যদি করতেই হয় হাজারো অভুক্ত, অভাবী, দুস্থ রোজাদারদের নিয়েই ইফতারির আয়োজন করা উচিত। সংযমের শিক্ষাকে পাত্তা না দিয়ে যথেচ্ছ খানাপিনায় ডুবে থাকার প্রবণতা আপত্তিকর ও ধর্মীয় চেতনার পরিপন্থী। ধনীদের মধ্যে আবর্তিত অপচয়নির্ভর ইফতার সংস্কৃতি গরিব দেশে মানায় না। এটা তো গরিবের প্রতি প্রচ্ছন্ন উপহাস। হয় গরিবদের অংশগ্রহণে ইফতারের আয়োজন চলবে নতুবা এই ভোজন উৎসব বর্জন করাই শ্রেয়।

আমাদের দেশে অনেক বিত্তবান আছেন কেবল লোক দেখানোর জন্য যাকাত ও ইফতার সামগ্রী বিতরণ করেন। অথচ তা ইসলামি নির্দেশনার পরিপন্থী। গরিবদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করতে হবে নিজ কর্তব্যবোধের তাগিদে, লোক দেখানোর জন্য নয়। ‘রিয়া’ বা লোক দেখানো ইবাদত আল্লাহ পাকের কাছে কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। এ দিকটি বিত্তবানদেরকে খেয়াল রাখার অনুরোধ জানাই।

আ ব ম খোরশিদ আলম খান : সাংবাদিক, কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App