×

মুক্তচিন্তা

বিপর্যস্ত আগামীর সংকেত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ মে ২০১৮, ০৬:২৬ পিএম

সব আয়োজনের ভেতরই রয়েছে ভয়াবহ গলদ। দায়সারা দায়িত্ব ও দায়বোধ। এমন কি রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। সেইসঙ্গে শিশু-কিশোরদের শুধুমাত্র একটা অংশকে সেবা বা অধিকারের আওতায় এনে কার্যক্রম বাস্তবায়নের চিন্তা। যেন সামর্থ্যবানদের আরো সামর্থ্যবান করে তোলা।

শিশু দুজনের বয়স আনুমানিক দশ কিংবা এগারো। গায়ের রং উভয়েরই ফর্সা। কিন্তু তার ওপর তামাটে তামাটে ভাব। অনেকটা পোড়ার মতন। চোখ ঘোলা, ঢুলুঢুলু । দৃষ্টিতে ক্লান্তি। পরনে হলুদ রংয়ের ময়লা টিশার্ট ও হাফ প্যান্ট। রাজধানীর ব্যস্ততম সড়কের আইল্যান্ডের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে ওরা। সড়কের উভয়মুখী পথে অফিস ফেরত মানুষের কোলাহল, ব্যস্ততা। জ্যামে দাঁড়িয়ে আছে সারিবদ্ধ অসংখ্য যানবাহন। ট্রাফিক পুলিশের বাঁশি ক্ষণে ক্ষণে বেজে উঠছে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের সড়ক হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুয়েকজন সদস্যও চোখে পড়ে। চোখে পড়ে এই দুজন শিশুকে সহজে, গাড়ির গ্লাসের ভেতর থেকে অথবা হেঁটে যাওয়া পথিকের দৃষ্টিতে। কোনো কিছুতে ভ্রুক্ষেপ নেই ওদের, কেউ দেখছে কী, দেখছে না। এ যেন তাদের জীবনের বাস্তবতা। ছোট্ট শরীরের সব শক্তি প্রয়োগ করে পলিথিনের ব্যাগ ফুলিয়ে দুহাতে তা নাক ও মুখে এনে কী যেন টেনে নিচ্ছে বুকের ভেতর। টানার সময় চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কেমন তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব। পলিথিনের ভেতর কী যেন রাখা। ধোঁয়ার মতন কী যেন টেনে একজন আরেকজনার কাঁধে মাথা রাখে, আবার সোজা হয়ে বসে। সন্ধ্যা ছয়টা ঘড়িতে তখন। ঘড়ির কাঁটা যে ঘরেই থাক এ দৃশ্য যত্রতত্র শহরের। শুধু শহর বললে ভুল বলা হবে, মফস্বল, গ্রামাঞ্চলেও দৃশ্যমান এখন এমনটি। সবাই তাই বলছে।

বর্ণনায় পাঠক নিশ্চয়ই বুঝে নিয়েছেন আমি কোন অবস্থার কথা বলছি। কোন জগতের শিশুদের কথা বলছি। এটা কোনো চলচ্চিত্রের গল্প, নাটকের দৃশ্য নয়, নিত্যদিনের দৃশ্যমান চিত্রের ধারাবর্ণনা। এ সব নিয়ে যদিও চলচ্চিত্র বা নাটক বানান অনেকেই। পুরস্কৃতও হন। বাণিজ্যের মাত্রাও হয়তো সীমা ছাড়ায়। না, আজ কোনো পরিসংখ্যানে যাব না। কোনো গবেষণার বুক চৌচির করে আক্ষেপ নিয়ে বলার চেষ্টাও করব না, কীভাবে নেশা গিলে খাচ্ছে আমাদের শিশুদের। নেশায় পুড়ে ছারখার, ছাই হচ্ছেই বা কতজন শিশু। এদের সংখ্যা কী হারে বেড়ে যাচ্ছে। দেখতে যাব না কী আছে জাতীয় পরিকল্পনায় এ সব শিশুদের নিয়ে, ওদের সুস্থ জীবন দিতে। যা দেখছি, চোখে পড়ছে নিত্যদিন, তার বর্ণনা দিলেই বুঝে নেয়া যায় কতটা করুণ অবস্থায় মাদকের ভেতর দিয়ে পথ পাড়ি দিচ্ছে এ সব শিশু-কিশোররা। শুধু বলি, শিশুদের দায়িত্ব নিয়ে সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন, শোনাছেন সে সবের সঙ্গে এমন দৃশ্যের যোজন তফাৎ। শহরের বড় বড় রাস্তার আইল্যান্ডে, রেল ও বাস স্টেশনে, অলিগলিতে, পার্কে সব জায়গায় এরা প্রকাশ্যে নেশা করছে, এ সব দেখলেই তফাৎ উপলব্ধি করা যায়। এতে আগামীর বাংলাদেশের যে করুণ চিত্রই ফুটে ওঠে, তা ভাবার চেষ্টা করলে গা শিউরে ওঠে। অথচ কী নির্বিকার আমরা! এরা যেন আগামী বাংলাদেশের গণনার বাইরে! কেন শিশুরা নেশা করছে? কেনই বা করে? বক্তৃতা, বক্তব্য দিতে বলা হলে অনেক বিশেষজ্ঞ কথা শেষ করতে পারবেন না। আবার নিজের মতন করে অনেকেই কথা বলবেন। অতীতের সঙ্গে বর্তমানের ফারাক খুঁজে বের করবেন। রাজনৈতিক ব্যর্থতা বা সফলতার কারণ ও গন্ধ খোঁজারও চেষ্টা করবেন। তবে সব চেষ্টা ঘুরেফিরে একই জায়গায় এসে দাঁড়াবে, যার সারমর্ম দাঁড়াবে দোষে। প্রথম দোষ ধরা হবে পরিবারের। দ্বিতীয় দোষ বন্ধুবান্ধবের। তৃতীয় দোষ সামাজিক অবক্ষয়ের। চতুর্থ দোষ রাজনৈতিক সরকারের। এভাবে পঞ্চম, ষষ্ঠ এবং তারপর লাইন ধরে আরো অনেক দোষ বের হবে, ধরা হবে, দেয়া হবে। দোষ দেয়ার সংস্কৃতি তো ব্যর্থতা ঢাকতে বেশ কার্যকরী ভ‚মিকা রাখছে। এই সংস্কৃতিতে কমবেশি সবাই সংস্কৃতিবান হচ্ছেন। যাইই হোক নির্দ্বিধায় বলা যায়, শিশুদের জন্য বাংলাদেশে অনেক কিছু আছে। যেমন মন্ত্রণালয় আছে, অধিদপ্তর আছে, একাডেমি আছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, পার্ক আছে, শিশু দিবস, শিশু অধিকার সপ্তাহ আছে, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আছে, শিশু অধিকার আইন আছে, শিক্ষাকার্যক্রমে শিশুদের অন্তর্ভুক্তি পাঁয়তারা আছে। তার লক্ষ্যমাত্রা যেমন আছে অর্জনও তেমন আছে। বোর্ড পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাসের হার দেখে কর্তৃপক্ষ আনন্দিত হন, শিশুদের আলোকিত ভবিষ্যতের কথা বলে ফেলেন। আবার শিশুদের নিয়ে সভা-সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কর্মশালা, মেলাও আছে। যেখানে আয়োজকরা নিজেদের শিশুদের শিশুবান্ধব বানিয়ে ফেলেন। আছে গান, চলচ্চিত্র। বুদ্ধিওয়ালা গোষ্ঠীও আছেন, আছে তাদের অনবরত ভাবনা ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছুই আছে। সুতরাং কিছু নেই, এমন বললে বলা ভুল হবে। বলতেও চাই না তা তাহলে কী নেই, যার অভাবে শিশু-কিশোররা এভাবে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে? খোলা আকাশের নিচে প্রকাশ্যে এভাবে ধ্বংস হওয়ার উন্মাদনায় কেন ওরা মত্ত? কেন একটুও ভীত নয় নিজেদের নিয়ে, আশপাশের পরিবেশ নিয়ে? ওরা কী ভেবে নিয়েছে ওদের দেখার কেউ নেই, কেউ থাকে না?

সব থেকেও শিশু-কিশোরদের ভয়াবহ ধ্বংসের মুখে যাওয়ার অন্যতম কারণগুলো হলো, সব আয়োজনের ভেতরই রয়েছে ভয়াবহ গলদ। দায়সারা দায়িত্ব ও দায়বোধ। এমন কি রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। সেইসঙ্গে শিশু-কিশোরদের শুধুমাত্র একটা অংশকে সেবা বা অধিকারের আওতায় এনে কার্যক্রম বাস্তবায়নের চিন্তা। যেন সামর্থ্যবানদের আরো সামর্থ্যবান করে তোলা। ফলে আরেকটা অংশ থেকে যাচ্ছে সেবা বা অধিকার ভোগের বইরে। যারা সমাজে সুবিধাবঞ্চিত হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। শুধু কী সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোররাই মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে, তাও কিন্তু নয়। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিশু-কিশোররাও মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। তবে সুবিধাবঞ্চিতদের মতন ব্যাপকহারে নয়, যত্রতত্র নয়।

এ সব শিশু-কিশোররা কেন ও কী ভাবে নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। কারণ জানলে সমস্যার সমাধা হওয়া সম্ভব, নতুবা নয়। জানি না তেমন পরিষ্কার ধারণা কারোর জানা আছে কিনা, ধারণা নিতে কাজ করছেন কিনা। তবে ওদের ভাষাতেই বলি, এ সব শিশু-কিশোররা গরিব। পড়ালেখা করানোর যে ক্ষমতা থাকা দরকার, তা এদের বাবা-মায়ের নেই। চাইলে স্বপ্ন দেখে কোনো স্কুলে গিয়ে এরা পড়ালেখা করতে পারে না। ভর্তি হতে পারে না। টাকা নেই, সুযোগ নেই। যা আছে অভাবের সংসারের হাল ধরতে অপরিণত বয়সে কাজে ঢুকে আয় করার সুযোগ। এদের হাতে টাকা এলে, আরো টাকা কামাই করতে এদের মন চায়। টাকার গুণ এটাই, মানুষকে নিজের দিকে টেনে নিতে পারে প্রবলভাবে, প্রচণ্ডভাবে। এতে এদের মন, চোখে রং লেগে যায়। পাড়া, মহল্লার বিপথগামী বড় ভাইদের দেখে যা মনে রেখেছে, যা মনে ধরেছে সে সবের সঙ্গে এই রং মিশে যায়। সেই রঙিন মন চায় বন্ধুদের নিয়ে ইচ্ছে মতন খেতে, সিনেমা দেখতে, আড্ডা মারতে, নেশা করতে, আরো কতকিছু করতে। শৃঙ্খলাবিহীন পরিবেশে বেড়ে উঠে তারা করেও তা। জীবনের স্বপ্ন, ইচ্ছে, পরিধি, সীমা সব যেন এর মাঝেই ঘুরপাক খায়। এরা জানে না এ দেশের মানুষের গড় আয় বা গড় আয়ু কী। এ সবের বাড়া বা কমা কী, তাও বোঝে না। বোঝে না উন্নয়ন কী, তাদের নিয়ে উন্নয়নটা হচ্ছে কী। এতসব বোঝার তাগাদাও নেই। কারণ সেই শিক্ষা নেই, শিক্ষা পায়নি বলেই। এদের জীবন যেন খেলনা গাড়ির মতন চাবি মেরে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, ঘুরতে ঘুরতে এক সময় ঘোরা শেষ হয়, জীবন থেমে যায়। কোনো পরিসংখ্যানে নেই এ সব গল্পের। ও সবে কার কী এসে যায়। যায়নি তো কখনোই।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে এ সব শিশু সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে। পরিবারের দরিদ্র অবস্থায় যা সম্ভব নয়। দারিদ্র্য দূর করা বিষয়টি সর্বাগ্রে গুরুত্ব পাওয়া জরুরি। প্রতিটি পরিবার আর্থিক সচ্ছলতার আওতায় এলে অর্থাৎ প্রকৃতভাবে দারিদ্র্যমোচন হলে তো শিশুদের সুস্থ জীবন পাবার কথা। দারিদ্র্যপীড়িত শিশুরা কখনোই সুস্থ জীবন পাবে না, পায়নি কখনো। সে সঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাযিত্ব হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। প্রকাশ্যে মাদক কেনাবেচা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো সদস্যের মাদক বাণিজ্যে সম্পৃক্ত থাকার কথা প্রায়ই শোনা যায়। যা ভয়ঙ্কর শোনায়। শিশু-কিশোরদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া জরুরি, যারা আগামী বাংলাদেশের ধারক ও বাহক এই সত্য অনুধাবন করার ব্যর্থতা অনেকটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমতুল্য হয় কিনা, আসুন একবার ভাবি।

স্বপ্না রেজা : লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App