×

অর্থনীতি

ভোটার তুষ্টির বাজেটে বাড়ছে করের আওতা

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ মে ২০১৮, ০৩:০১ পিএম

ভোটার তুষ্টির বাজেটে বাড়ছে করের আওতা
ভোটার তুষ্টির বাজেটে বাড়ছে করের আওতা
নির্বাচনের বছরে ভোটার তুষ্টির বাজেট দিতে চায় সরকার। আসন্ন বাজেটে বাড়বে করমুক্ত আয় সীমা। পাশাপাশি চালু করা হবে সার্বজনীন পেনশন স্কিম। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের আওতায় ঘরে বসেই পাওয়া যাবে পেনশনের টাকা। বিতর্কিত ভ্যাট আইন নিয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে না। তবে কর না বাড়লেও করের আওতা বাড়ানোর কর্মসূচি রাখা হবে। উন্নয়ন খাতকে গুরুত্ব দিয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য বড় এ বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এবারে সাংসদরা রাস্তাঘাটের পাশাপাশি স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ-মন্দির নির্মাণের জন্যও বরাদ্দ পাচ্ছেন। চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কাজেই এবারের বাজেটকে নির্বাচনী বাজেট হিসেবে আখ্যায়িত করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, ভোটারদের তুষ্ট করতে নতুন অর্থবছরের বাজেটে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হবে। যাতে ভোটাররা কোনোভাবেই চাপের মুখে না পড়েন সেদিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে। এর অংশ হিসেবেই আগামী বাজেটে সব ধরনের অপ্রয়োজনীয় কর থেকে অব্যাহতি দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। আয়কর দেয়ার ক্ষেত্রে হয়রানি কমাতে ই- পেমেন্ট এবং ই-ফিলিং চালু করার ঘোষণা আসতে পারে। একই সঙ্গে রাজস্ব আদায় বাড়াতে সংশোধন করা হবে বিটিআরসির আইন। এ ছাড়া রাজস্ব ব্যয়ের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ১৩ ডিজিটের পরিবর্তে ৩৭ ডিজিটের বাজেট ও অ্যাকাউন্টিং ক্লাসিফিকেশন পদ্ধতি চালু করা হবে। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগীদের ভাতা জি টু পি (গভর্মেন্ট টু পাবলিক) পদ্ধতিতে সরাসরি প্রদান পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি পেনশন ডাটাবেজ প্রণয়ন, ই-চালান ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে সরকারের অর্থ অপচয় রোধ এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা গতিশীল করা হবে। এ প্রসঙ্গে অর্থসচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী জানান, এটি নির্বাচনী বছর। এ জন্য স্বাভাবিক বাজেট দেয়া হবে। বাজেটের আকার বাড়ানো হবে। ইতোপূর্বে যেসব মেগাপ্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলোর দ্রæত বাস্তবায়নে কাজ করছে সরকার। তিনি বলেন, আগামী বাজেটে সার্বজনীন পেনশনের ঘোষণা দেয়া হবে। এ ছাড়া ঘরে বসেই যাতে সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারীরা পেশনের টাকা পেতে পারেন সেই উদ্যোগ নেয়া হবে। ইতোমধ্যে পাইলট প্রকল্পের আওতায় ঘরে বসে অনেকে পেনশনের টাকা পাচ্ছেন। জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকার দৃশ্যমান উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ জন্য পদ্মা  সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল লাইন, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, রামপাল থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট, চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে গুমদুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর এবং এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। এ জন্য এসব প্রকল্পে চলতি বছরের তুলনায় অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। চলতি বছর এ খাতে ৩৩ হাজার ১৮২ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। সরকার এসব প্রকল্পের অগ্রগতি দেখিয়ে শেষ সময়ে ভোটারদের কাছে উন্নয়নের বার্তা পৌঁছে দেবে। জানা গেছে, দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যেতে বিনিয়োগ ও ব্যবসাবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে আগামী বাজেটে। সুদের হার নামিয়ে আনা হবে এক ডিজিটে। সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হচ্ছে না। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার উদ্যোগ থাকছে। চলতি অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করায় আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করা হতে পারে ৮ শতাংশ। ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ানো হবে। মোট জিডিপির ১ দশমিক ১ শতাংশ বরাদ্দ থাকছে ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে। এমপিওর মতো বন্ধ অনেক কর্মসূচি ফের চালুর বিষয় বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। ঢাকা শহর যানজটমুক্ত করতে দ্রæত মেট্রোরেল প্রকল্পের বাস্তবায়নসহ নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া নির্বাচনকে সামনে রেখে ১০ মেগা প্রকল্প দ্রæত বাস্তবায়নসহ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এডিপিতে রেকর্ডসংখ্যক নতুন প্রকল্প নেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ২০১৮-১৯ সালের বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, সবার জন্য স্বস্তিদায়ক একটি বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় ও কর ও ভ্যাট থেকে এবার অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে। তবে সরকারের আয় বাড়াতে করের আওতা বাড়ানো হবে। তিনি বলেন, দেশের তরুণরা এখন কর দিচ্ছে। এটাই এখন বড় শক্তি। জানা গেছে, আগামী বাজেটে মানবসম্পদ উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে। এ জন্য পৃথক স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট ও মন্ত্রণালয় গঠনেরও প্রস্তাব করা হবে। এ ছাড়া উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক স্বীকৃতি পাওয়ায় উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের ধারা অব্যাহত রাখতে চায় সরকার। বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাম্পার অভ্যন্তরীণ উৎপাদনকে ব্যাহত না করলে ২০১৮-১৯ অর্থবছর ৮ শতাংশের কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে আশা করা হচ্ছেÑ যা হবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ইতোমধ্যে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছেÑ যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। যদিও সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২০ সালে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। সূত্র মতে, চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৮ দশমিক ৩২ শতাংশ বেশি রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর আয়ের লক্ষ্য হচ্ছে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। নন-এনবিআর রাজস্বের লক্ষ্য ১১ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। করবহির্ভূত রাজস্ব হচ্ছে ৩৩ হাজার ১১০ কোটি টাকা। নতুন বাজেটেও বড় অঙ্কের ঘাটতি থাকছে। এই ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেয়া হবে। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্য ৩৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া হবে ৮৮ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকার ঋণ। তবে অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়া হবে ৫৯ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া আগামী অর্থবছরে জিডিপি টাকার অঙ্কে দাঁড়াবে ২৫ লাখ ৪৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে জিডিপির আকার হচ্ছে ২২ লাখ ২৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার সহনীয় মাত্রায় থাকবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ার সম্ভাবনা নেই। পাশাপাশি ভারত ও চীনে মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখী প্রবণতা বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির ওপর নিম্নমুখী চাপ সৃষ্টি করতে পারে। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতির সম্ভাবনা কম। জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো দিক-নির্দেশনামূলক চিঠিতে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে আসন্ন নির্বাচন। ওই নির্দেশনায় চলমান প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, নতুন প্রকল্প গ্রহণের চেয়ে চলতি বছরে শেষ করা যাবে এমন প্রকল্পকে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ ছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মধ্যে শেষ করা যাবে এমন সব প্রকল্পের পৃথক তালিকা পাঠাতে বলা হয়েছে। তবে সতর্ক করে বলা হয়েছে, আগামী ৩০ জুনের মধ্যে মেয়াদ উত্তীর্ণ কোনো প্রকল্প নতুন করে মেয়াদ বাড়ানো ছাড়া আগামী এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। এ ছাড়া পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্প, বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত প্রকল্প, বৈদেশিক সহায়তা প্রাপ্তির সুবিধার্থে বরাদ্দ ছাড়া অননুমোদিত প্রকল্পের আলাদা তালিকা পাঠাতে বলা হয় মন্ত্রণালয়গুলোকে। এদিকে, এত দিন রাস্তাঘাট নির্মাণেই সাংসদরা বিশেষ বরাদ্দ পেতেন। নির্বাচন সামনে রেখে এবার স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ-মন্দির নির্মাণের জন্য তারা বরাদ্দ পাচ্ছেন। প্রত্যেক সাংসদের ইচ্ছা অনুযায়ী, তাদের নির্বাচনী এলাকায় ১০টি নতুন বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল ভবন নির্মাণ, ১০টি পুরনো স্কুল ভবনগুলোর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা এবং এক কোটি টাকার মসজিদ মন্দির নির্মাণ করে দেবে। ইতোমধ্যে সাংসদরা তাদের চাহিদাপত্র দেয়া শুরু করেছেন। মূলত নির্বাচনের বছরে ভোটারদের তুষ্ট করতে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকার এসব প্রকল্প নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক পরিচালক এবং অগ্রণী ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, উন্নয়নের চাহিদা বেড়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবে এডিপির বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এ ছাড়া রূপকল্প-২১ বাস্তবায়ন এবং দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যেতে এডিপি অন্তর্ভুক্ত প্রকল্পগুলো যথা সময়ে শেষ করতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App