×

মুক্তচিন্তা

পরিবার জানতো জহিরুল বেঁচে নেই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ মে ২০১৮, ০৬:১০ পিএম

বিদেশে যাওয়া দোষের কাজ নয়, বরং বাংলাদেশের যুবকদের জন্য বিদেশ যাওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ যেহেতু বাংলাদেশে কম তাই তারা ভালো চাকরির জন্য, ভালো থাকার জন্য, নিরাপদ জীবনযাপন করার জন্য উন্নত দেশে যেতেই পারে। কিন্তু তা হতে হবে বৈধ পথে। অবৈধ পথ শুধু ফাঁকির পথই নয়, অবৈধ পথ মৃত্যুফাঁদের পথও বটে।

জহিরুল ইসলাম বাংলাদেশের গাজীপুরের মানুষ। বয়স ২৫ বছর। পড়াশুনা করার তেমন সুযোগ পায়নি জহিরুল। গ্রাম-শহরের আর দশটি যুবকের মতোই জহিরুলের মাথায় ভ‚ত চেপেছিল বিদেশে যাবে। এ সব কাজে তো দালাল খুঁজতে বেশি দূর যেতে হয় না। জহিরুল পেয়ে যায় এক দালালের খোঁজ। টাকা হলে নাকি বিদেশ কেন, চাঁদেও পাঠাতে পারে এই দালাল। জহিরুল যোগাযোগ করলে বলা হলো ১০ লাখ টাকা লাগবে। দরিদ্র জহিরুলের বাবা অল্প-স্বল্প জমিজমা যা ছিল বিক্রি করে দিল। তাতেও তো শেষ রক্ষা হলো না। শুরু হলো ঋণ করার উপযুক্ত জায়গা। আত্মীয়-স্বজন এবং চড়া সুদে ঋণের ব্যবস্থাও হলো। উন্নত জীবনের আশায় ২০১৩ সালে সমুদ্রপথে জহিরুল পাড়ি জমায় মালয়েশিয়ার উদ্দেশে। কিন্তু মালয়েশিয়ার গন্তব্যে পৌঁছানো হয়নি তার। দালাল, তস্য দালাল ইত্যাদি ইত্যাদি- শুধু হাত বদলের খেলা। জহিরুলকে জানান হলো, মালয়েশিয়া যাওয়া যাবে না। তাকে নেয়া হলো ইন্দোনেশিয়া। কিন্তু সেখানেও নয়। তারপর নেয়া হলো অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়াতেও থাকার সুযোগ হলো না। পথ ঘুরে সবশেষে জহিরুলের ঠাঁই হলো পাপুয়া নিউগিনির এক ক্যাম্পে। পাপুয়া নিউগিনির এই ক্যাম্পে জহিরুলের কেটে গেল চারটি বছর। পরিবারের সঙ্গে প্রথমদিকে দুয়েকবার যোগাযোগ করতে পারলেও পরে আর কোনো যোগাযোগ করতে পারেনি সে। জহিরুল হক যে বেঁচে আছে, তা জানতে পারেনি জহিরুলের পরিবার। পুত্রশোক, ঋণের বোঝা, জমি বিক্রির বেদনা এ সব সইতে পারেননি জহিরুলের বাবা। ছেলে চলে যাওয়ায় পর মারা যান জহিরুলের বাবা। কিন্তু জহিরুল বাবার মৃত্যুসংবাদ সঙ্গে সঙ্গে পায়নি। ততদিনে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সব সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এবার যখন সে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারল, তখনই জানল- তার মাথার ওপরের ছাদটুকু তার বাবা তাকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। পরিবারের ধারণা ছিল-জহিরুল আর বেঁচে নেই।

অস্ট্রেলিয়া পৌঁছানোর পর জহিরুল দেখতে পায়, তারই মতো আরো অনেক বাংলাদেশি রয়েছেন সেখানে। এরাও কাজের খোঁজে দেশের বাইরে যেতে গিয়ে এখানে এসে আটকা পড়েছেন। অস্ট্রেলিয়া কর্তৃপক্ষ অবৈধ বাংলাদেশিদের তার নিজের দেশে ঠাঁই না দিয়ে বরং সমুদ্রপথে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ পাপুয়া নিউগিনির একটি অভিবাসী ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। পাপুয়া নিউগিনির ক্যাম্পে তাদের বলা হয়, বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের অন্য কোনো দেশে পাঠানো হবে। কিন্তু এরই মধ্যে চার বছর পার হয়ে গেছে। কোনো প্রশিক্ষণও মেলেনি, অন্য কোনো দেশে যাওয়ার সৌভাগ্যও হয়নি। জহিরুলের ধারণা, একদিন হয়তো সে আবার দেশে ফেরত আসতে পারবে। পাপুয়া নিউগিনির ক্যাম্প থেকে বিবিসি বাংলা জহিরুলের একটি সাক্ষাৎকার নেয়। আর এতেই জহিরুলের মতো আরো কিছু দুর্ভাগ্যের শিকার বাংলাদেশিদের কথা বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসী জানতে পারে। পাপুয়া নিউগিনি নিয়ে আমার ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতা আছে। আমি তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরি করি ক্যাপ্টেন র‌্যাঙ্কে। যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর একটি যৌথ মহড়া হয়েছিল বাংলাদেশে। যুক্তরাষ্ট্রের আহবানে আরো কয়েকটি দেশও যোগ দিয়েছিল এই মহড়ায়। কয়েকটি ছোট দেশও ছিল তাতে। তার মধ্যে একটি ছিল পাপুয়া নিউগিনি। পাপুয়া নিউগিনি থেকে একজন লে. কর্নেল এবং একজন মেজর এই দুজন অফিসার এসেছিলেন। আমি সরকার থেকে একটি গাড়ি পেয়েছিলাম যা দিয়ে সভা-বেড়ানো স্থলে এই দুজন অফিসারকে নিয়ে যেতাম। চলতে চলতে এই দুজন অফিসারের সঙ্গে আমার বেশ সখ্যই হলো। খুব ছোট সেনাবাহিনী তাদের দেশের। দলপ্রধান লে. কর্নেল সেই দেশের সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় কর্তাব্যক্তি। তাদের সেনাবাহিনীর প্রধান ছিল তখন একজন কর্নেল র‌্যাঙ্কের অফিসার। একটি বড় সোনার খনি ছাড়া তাদের দেশে তখন কিছুই ছিল না। তাদের দেশ সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়ার সুযোগ হয়তো আমার নেই। তবে একটি উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবেন দেশটির মানুষের আচার-আচরণের কিছুটা ধরন। ঢাকা দেখাতে আমি তাদের এক বিকেলে গুলিস্তান দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন গুলিস্তানে মানুষের ভিড় চরমে। গাদাগাদি করে মানুষ হাঁটছে। এমনটা দেখে তারা মন্তব্য করল, বাংলাদেশের মানুষ এত ভদ্র? আমি ঠিক বুঝতে না পেরে জানতে চাইলাম, কীভাবে তারা তা বুঝলেন। তারা ব্যাখ্যা দিলেন, এত মানুষ একসঙ্গে হাঁটছে কিন্তু একজনও অন্যজনের ওপর চড়াও হচ্ছে না; কোনো মারামারি হচ্ছে না। পাপুয়া নিউগিনির দুই অফিসারই বললেন, তার দেশ হলে এতক্ষণে ওখানে কয়েকজনের লাশ পড়ে যেত। পাপুয়া নিউগিনি সম্পর্কে জানতে আমার তখন আর বেশি কোনো অভিজ্ঞতার প্রয়োজন ছিল না। তাদের মন্তব্যই যথেষ্ট ছিল। সেই পাপুয়া নিউগিনি আজ হয়তো সেই জায়গায় নেই। কতটুকু বদলেছে জানি না। তবে জহিরুল সেই পাপুয়া নিউগিনির একটি ক্যাম্পে আটকা পড়ে আছে জেনে মনে হলো, জহিরুলের দেশে ফিরে না আসার বিকল্প নেই।

অবৈধ অভিবাসন চলছে, চলবেই। জীবিকার টানে কিংবা নিছক কৌত‚হলের বশবর্তী হয়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে মানুষ অন্য প্রান্তে স্থানান্তরিত হতে চায়। স্বপ্ন দেখে সুখী জীবনের। অনেক সময়ই অনেকে বৈধ পথে না যেতে পেরে পাড়ি দেয় অবৈধ পথে। পাড়ি দেয় অক‚ল সমুদ্রে। তাদের অনেকের ভাগ্যেই জোটে জহিরুলের মতো এমন পরিণতি। অভিজ্ঞতার অভাব, জ্ঞানের অভাব, যেখানে যেতে চায় সেই দেশের তথ্য সংগ্রহের অভাব ইত্যাদি কারণে প্রায়ই দেখা যায়, বাংলাদেশের কিছু মানুষ অনিশ্চিত একটি ভবিষ্যতের পথে পা বাড়ায়। সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে একদিন দেশে ফিরে আসে তারা। কেউ কেউ প্রাণে বেঁচেও আসতে পারে না। মালয়েশিয়া কিংবা অন্য কোনো দেশের জঙ্গলের মধ্যে দস্যুদের হাতে প্রাণ যায় কত না জানা অসহায় বাংলাদেশিদের। এমনই এক গল্প শুনেছিলাম কোনোভাবে প্রাণে বেঁচে যাওয়া এক বাংলাদেশির কাছে। বর্তমানে সে ইতালিতে আছে। দালালের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ ঘুরে শেষ পর্যন্ত সে ইতালিতে আছে। কিন্তু বৈধ নয়, অবৈধভাবে থাকছে সেখানে। তাতেই যেন খুশি সে। অন্তত প্রাণটাতো বেঁচে আছে। ইউরোপের এক দেশ থেকে অন্য দেশের চোরাইপথে যাওয়ার সময় দালালের ভুল রাস্তা শনাক্ত করার ফলে এই বাংলাদেশি মৃত্যুর মুখে পড়েছিল। অথৈ পানিতে আবর্জনার স্তূপে লুকিয়ে ছিল কয়েকজন অবৈধ অভিবাসী। নিয়মিত প্রহরারত রক্ষীদের হাতে পড়ে যাওয়ার ভয়ে গভীর রাতে ভুল করে আবর্জনা সরে গিয়ে অথৈ পানিতে পড়ে যায় সে। জেগে উঠলে প্রহরীর হাতে আর ডুবে গেলে নিশ্চিত মৃত্যু। এই দুয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ওই বাংলাদেশি অলৌকিকভাবে একটি গাছের ছোট্ট ভাঙা ডাল পেয়ে যায়। ডালটা ধরে নাকটা কোনোভাবে ওপরে তুলে সারা শরীর পানির মধ্যে ডুবিয়ে রেখে সেদিন সেই শীতের রাতে কোনোভাবে প্রাণে বেঁচেছিল সে। তারপর ইতালি পৌঁছে যেতে পারে কোনোভাবে। দালালের হাতে সর্বস্ব হারিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে প্রথম দিকে। এক সময় খোলা রাস্তায় ফেরি করে জীবন ধারণ করে এই বাংলাদেশি। সেই বাংলাদেশির কথাই বলব- কীভাবে তার সঙ্গে আমার দেখা হলো এবং তার জীবনের করুণ ঘটনা জানতে পারলাম। রোমের এক রাস্তায় হাঁটছিলাম। দেখলাম এক বাংলাদেশি যুবক রাস্তায় একটি কাপড় বিছিয়ে কয়েকটি কম দামের হাতঘড়ি বিক্রি করছে। হঠাৎ করে দেখলাম, কাপড় গুটিয়ে সে দৌড়ে পালাল। কৌত‚হলে আশপাশে তাকিয়ে দেখে বুঝলাম, অদূরে পুলিশকে আসতে দেখে সে পালিয়েছে। আরো কৌত‚হল হলো। যুবকটির পিছু নিলাম এবং এক সময় ধরে ফেললাম। তারপর জানলাম তার দুঃখের ইতিহাস। নারায়ণগঞ্জের ছেলে। বিএ, এমএ, সবটুকুই করেছিল। কিন্তু দেশে কিছু করতে পারেনি সে। বিদেশে যাওয়ার ভ‚ত চেপেছিল তার মাথায়। দালাল ধরে ইউরোপ যেতেই হবে। জিদে কাজ হয়েছিল। ইউরোপ পাড়ি দিয়েছিল দালাল ধরে। কিন্তু ওই সেই একই ইতিহাস। সব হারিয়ে সবশেষে ইতালি। কিন্তু তারপরও সে খুশি; অন্তত কিছু টাকা বাড়িতে পাঠাতে পারে সে। পরিবারের কেউ জানে না তার করুণ অবস্থার কথা। তারা শুধু বুঝে- ছেলে তাদের ইতালি থাকে।

আরো অনেক গল্প আছে এমন ধরনের। এগুলো জীবনের গল্প, প্রবঞ্চনার গল্প। বৈধ পথে ইতালি যাবে, ইউরোপ যাবে, কানাডা যাবে, আমেরিকা যাবে- তাতে বলার কিছু নেই। ভাগ্যের পরিবর্তনে চেষ্টা করতেই পারে। কিন্তু অবৈধ পথে তেমন চেষ্টা করার নাম তো আগুন নিয়ে খেলার মতো। তাতে সর্বস্ব হারানোর ভয় থাকে, জীবনের ভয় থাকে। জহিরুলের কথা একবার চিন্তা করুন। বাবা হারিয়েছে, সম্পত্তি হারিয়েছে। সর্বস্ব হারিয়ে চার বছরের বেশি সময় ক্যাম্পে বন্দিজীবন শেষে তাকে হয়তো একদিন শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতে হবে। নতুন করে শুরু করতে হবে তার জীবন। কিন্তু অর্থ যা হারিয়েছে, স্বজনকে যে হারিয়েছে, যৌবনের চারটি বছর যে হারিয়েছে- তা তাকে ফিরিয়ে দেবে কে? যে সব দালাল নিরীহ মানুষদের এমন বিপথে চালনা করার বুদ্ধি দিচ্ছে, তারা কি একবারও ফিরে তাকাবে না এসব সর্বহারা মানুষদের দিকে? বিদেশে যাওয়া দোষের কাজ নয়, বরং বাংলাদেশের যুবকদের জন্য বিদেশ যাওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ যেহেতু বাংলাদেশে কম তাই তারা ভালো চাকরির জন্য, ভালো থাকার জন্য, নিরাপদ জীবনযাপন করার জন্য উন্নত দেশে যেতেই পারে। কিন্তু তা হতে হবে বৈধ পথে। অবৈধ পথ শুধু ফাঁকির পথই নয়, অবৈধ পথ মৃত্যুফাঁদের পথও বটে।

মেজর সুধীর সাহা (অব.) : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App