×

মুক্তচিন্তা

মানবিক গুণাবলি অর্জনে মাসব্যাপী প্রশিক্ষণের সুযোগ

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ১৭ মে ২০১৮, ০৯:২১ পিএম

মাহে রমজানে সংযমের কথা খুব বেশি করে বলা হলেও এ মাসেই চলে বেশি অসংযম ও অমিতাচার। একশ্রেণির অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর কাছে রোজার মাস মানে চুটিয়ে টাকা কামানোর মোক্ষম সুযোগ। এই মুনাফাখোর অসাধু ব্যবসায়ীদের লাগাম টেনে ধরে ভোক্তা সাধারণসহ রোজাদারদের ভোগান্তি লাঘবে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। রমজান মাসে বাজার মনিটরিং জোরদার করা দরকার।

ভিন্ন আমেজ ও মহিমায় ভাস্বর মাহে রমজান শুরু হলো। মহান স্রষ্টা আল্লাহ পাকের করুণা, ক্ষমা ও জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতির সুসংবাদ নিয়ে এলো মাহে রমজান। ক্লেদাক্ত, কদর্য ও গ্লানিময় জীবনধারা আমূল পাল্টে যায় এই রোজার মাসের প্রাণবন্ত ছোঁয়ায়। বছরের এগারোটি মাসে আমরা নানাভাবে সীমা লঙ্ঘন ও পাপাচারে জড়িয়ে নিজেদের কালিমালিপ্ত করি। আর রোজার মাসটিতে আমরা আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংশোধনের মওকা খুঁজে পাই। রোজার স্নিগ্ধময় পরশে ও পুণ্য আবহে আমরা অবগাহনের সুযোগ পাই। সারা বছর পাপে তাপে দগ্ধ জীবনাচারে আমরা অভ্যস্ত থাকলেও রোজার মাসটি এলে আমরা নবোদ্যমে নতুন প্রেরণা ও চেতনায় ঘুরে দাঁড়াই। রোজা আমাদের জন্য অফুরন্ত রহমতের বার্তা নিয়ে আসে।

অশান্তি, অস্থিরতা, অনাচার, অবক্ষয় ও পঙ্কিলতা আমাদের সামগ্রিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। মানুষ প্রচণ্ডভাবে আজ শান্তি ও স্বস্তির খোঁজে হন্যে হয়ে উঠলেও কোথাও দুদণ্ড শান্তি নেই। মানুষের স্বাভাবিক শান্তির প্রত্যাশা ও স্বপ্ন আজ উধাও। ভোগ, লিপ্সা, ক্ষমতার মোহ ও সম্পদের প্রতি অসীম আসক্তি আমাদের জীবনকে গ্লানিময় ও বিষাদপূর্ণ করে তুলেছে। ঠিক এই সময়ে রোজা এসেছে আত্মশুদ্ধি, সংযম, ত্যাগ ও পুণ্যাচারের মহা সওগাত নিয়ে। বছরের এই ব্যতিক্রমী রোজার মাস আমাদের পুণ্যসিক্তির বিরাট সুযোগ এনে দেয়। মুসলমানরা রোজার মাসটি কাটায় সিয়াম সাধনাসহ নানা ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে। এই রোজার মহিমাময় মাসটি সত্যি সত্যি যেন আমরা সংযম সাধনা ও ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে কাটাতে পারি আজ রোজার শুরুর এই দিনে আমাদের দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করতে হবে। রোজার আলোকছটায় নিজেদের কলুুষময় জীবনকে পুণ্যসিক্ত, আলোকিত ও মহিমাময় করে গড়ে তুলতে হবে।

ইসলামের পাঁচ ভিত্তির অন্যতম রোজা। সুস্থ, সাবালক ও শারীরিকভাবে সক্ষম মুসলমানদের জন্য রমজান মাসে রোজা রাখা ফরজ। কুরআন মজিদে রোজার বিধান দিয়ে আল্লাহ পাক বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যেন তোমরা তাকওয়া (আত্মশুদ্ধি) অর্জন করতে পার’। (সুরা বাকারা ১৮৩নং আয়াত)।

হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ পাক বলেন, আস সওমু লি, ওয়াআনা আজজি বিহি অর্থাৎ ‘রোজা আমার জন্য, আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব।’ মানবতার নবী রাহমাতুল্লিল আলামিন হজরত মুহম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসে রোজা রাখবে, তার অতীতের সব গুনাহ (পাপ) ক্ষমা করে দেয়া হবে’ (বুখারি ও মুসলিম)।

রোজার মাসে প্রতিদিন রাতে এশার নামাজ শেষে ২০ রাকায়াত তারাবির নামাজ আদায় করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা তথা অবশ্য পালন করতে হবে। রোজার সঙ্গে তারাবির সম্পর্ক ও সংযোগ অত্যন্ত নিবিড়। তারাবির নামাজ ঐচ্ছিক নয়, আবশ্যিক। রোজার মাসে প্রতি রাতে তারাবির নামাজ আদায়ের নির্দেশনা দিয়েছেন স্বয়ং প্রিয় নবী (দ.)। তাই তারাবির নামাজ আদায়ে শৈথল্য বা উদাসীনতা প্রদর্শনের সুযোগ নেই। এখানে উল্লেখ্য, যুগ যুগ ধরে সাহাবায়ে কেরামের জমানা থেকেই তারাবির নামাজ ২০ রাকায়াত হিসেবে আদায় করে আসছেন মুমিন মুসলমানরা। তাই অধুনা তারাবির নামাজ ২০ রাকায়াত নয়, ১২ রাকায়াত বা ৮ রাকায়াত আদায় করলেও চলবে মর্মে ইসলাম বিকৃতকারী লা মাযহাবি সালাফি গোষ্ঠীর অপ্রপচারে বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না। তারাবির নামাজ ২০ রাকায়াতই, ১২ রাকায়াত বা ৮ রাকায়াত নয় এটাই ইসলামি বিধানের চ‚ড়ান্ত ফয়সালা। কেউ যদি প্রবল শারীরিক অসুস্থতা বা গ্রহণযোগ্য কোনো কারণে ২০ রাকায়াত তারাবি নামাজ পড়তে না পারেন, তা ভিন্ন বিষয়। অপারগতা ও অক্ষমতার প্রশ্নে ইসলামের সায় ও ছাড় আছে। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই ২০ রাকায়াত তারাবির নামাজ পালন না করা দোষণীয় ও গুনাহ। এ ব্যাপারে সম্মানিত রোজাদারদের সচেতনতা জরুরি।

পবিত্র রমজান মাসে নামাজে তারাবির ফজিলত বর্ণনায় বুখারি ও মুসলিম শরিফে রয়েছে- যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসে তারাবির নামাজ পড়বে, তার অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। রাতে অনেক সময় নিয়ে তারাবির নামাজ আদায় করা, মধ্যরাতে জেগে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় এবং সাহরি গ্রহণ, সারাদিন উপবাসব্রত পালন, সন্ধ্যায় ইফতার এ সব হচ্ছে রমজান মাসের সংস্কৃতি। রোজার মাধ্যমে আত্মিক উন্নতি ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা অর্জিত হয়। কঠিন সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রোজাদার আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের সতত প্রয়াস চালায়। মানবিক গুণাবলি অর্জনের বাস্তব প্রশিক্ষণের সুযোগ এনে দেয় মাসব্যাপী সিয়াম সাধনা। নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতা মেনে চলার চেতনা ও প্রেরণা লাভ করেন একজন রোজাদার। নির্দিষ্ট সময়ে তারাবির নামাজ আদায়, রাতে নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে সাহরি গ্রহণ, ফজরের নামাজ আদায় এবং দিনমান রোজা রেখে সন্ধ্যায় নির্দিষ্ট সময়ে ইফতার গ্রহণ এ সবই হলো রোজার নিত্য কর্মসূচি। এতে রোজাদার অশেষ পুণ্যার্জন করে।

মাহে রমজান সংযমের কথা খুব বেশি করে বলা হলেও এ মাসেই চলে বেশি অসংযম ও অমিতাচার। একশ্রেণির অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর কাছে রোজার মাস মানে চুটিয়ে টাকা কামানোর মোক্ষম সুযোগ। এই মুনাফাখোর অসাধু ব্যবসায়ীদের লাগাম টেনে ধরে ভোক্তা সাধারণসহ রোজাদারদের ভোগান্তি লাঘবে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। রমজান মাসে বাজার মনিটরিং জোরদার করা দরকার। সব ধরনের পণ্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে। ভেজাল ও নিম্নমানের ভোগ্যপণ্যের বেচাকেনা বন্ধে সরকারি কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। রোজার মাসে লোডশেডিং নয়, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ চাই অন্তত সাহরি, ইফতার ও তারাবির নামাজের সময়। রোজার কল্যাণময় বরকতপূর্ণ মাসটি আমরা যেন ভালোয় ভালোয় কাটাতে পারি মহান আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা জানাই।

আ ব ম খোরশিদ আলম খান : সাংবাদিক, কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App