×

পুরনো খবর

বাংলাদেশের আকাশ জয় স্বপ্নের বাস্তবায়ন

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ মে ২০১৮, ০৭:৫২ পিএম

টাকার অঙ্কের লাভক্ষতির হিসাব করলে কি কখনো বিজ্ঞান চর্চা বা সৃজনশীল বা অনুসন্ধানমূলক কাজ করা সম্ভব? সফল ও ব্যর্থ হওয়ার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয় এমন ধরনের কাজ। এ সব নেতা যে বক্তৃতা দিচ্ছেন, টেলিভিশনের সময় নিচ্ছেন, পত্রিকার পাতা ভরছেন; তার লাভ-ক্ষতির হিসাব রাখবে কে?

‘হাউই চড়ে চায় যেতে কে/ চন্দ্র লোকের অচীনপুরে/ শুনব আমি, ইঙ্গিতে কোন/ মঙ্গল হতে আসছে উড়ে।/ পাতাল ফেড়ে নামব নীচে/উঠব আবার আকাশ ফুঁড়ে,/বিশ্ব জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।’ জাতীয় কবি নজরুলের ‘সংকল্প’ কবিতার এই লাইনগুলো পড়ে ছোটবেলায় আকাশে উড়তে চাননি বা উৎসাহিত হননি, এমন কোনো বাঙালি-সন্তান পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে আমরা যখন স্কুলের ছোট ক্লাসে পড়ি, তখন কবিতাটি পড়ে আকাশ জয়ের কত স্বপ্নই না দেখতাম! স্বপ্ন সত্য হলো- ভোর রাতে। উড়ল বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট আকাশে। ওড়ার মুহূর্তে- ধোঁয়া যখন বের হয়, তখন চোখে পানি ধরে রাখতে পারিনি। কত যে স্মৃতি আকাশ বিজয় নিয়ে। স্কুলজীবন তখনো শেষ হয়নি; ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক-১ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয় এবং মহাকাশ থেকে প্রথম ইঙ্গিত বা সংকেত ভেসে আসে। স্পুটনিক-২তে কুকুর লাইকা যায় মহাকাশে। ১৯৫৮ সালে ধনতান্ত্রিক আমেরিকার ভ্যানগার্ড-১ মহাকাশে যায়। আমাদের জাতীয় কবির কল্পনা বাস্তবে রূপ নিতে থাকে। সেই সময়েই হয় সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের ভেতর দিয়ে আমাদের জাতীয় সত্তার নবোত্থান। জাতীয় জীবনের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জাগরণের ওই দিনগুলোতে বাংলার ছাত্র-তরুণ-যুবক আমরা ক্রমেই স্পুটনিক-ভ্যানগার্ড দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ি। ইতিহাসের পথপরিক্রমায় আজ এতদিন পর নির্দ্বিধায় এটা বলা যায় যে, মানব জাতি মহাকাশকে যতই হাতের মুঠোয় আনতে থাকে আর আমাদের জাতীয় জাগরণ যতই ব্যাপক ও গভীর হতে থাকে; ততই জাতি হিসেবে আমরা বিশেষত আমাদের মতো ছাত্র-তরুণ-যুবকরা স্পুটনিকমুখী বা সমাজতন্ত্রমুখী হতে থাকি।

মহাকাশে আমরাও যাব এটা ছিল আমাদের তরুণ মনের আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন। ষাটের দশকের প্রথম দিকে, আমি যখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র, তখন সহপাঠী বন্ধুরা আকাশ জয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকতাম। স্পুটনিকের প্রভাবসহ নানামুখী কারণে সহপাঠীদের মধ্যে বিপুল সংখ্যাধিক্য হিসেবে আমরা বাম ছাত্র আন্দোলন-সংগঠনের কর্মী হয়ে উঠেছিলাম। ওই প্রেরণা থেকে মূলত নিজেদের খরচের টাকায় ‘বিদ্যুৎ’ নামে একটি বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশ ছিল এরই বহিঃপ্রকাশ। তরুণ মন তখন আকাশে রকেট ওড়াতে অতি উৎসাহী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কোনো সাহায্য বা উৎসাহ বিশেষত মাথার ওপরে ছাতা ছাড়া তখন ওটা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এক সময় সেই সুযোগও আমাদের হাতে এসে গেল। ১৯৬৬ সালের ২২-২৪ নভেম্বর রুশপন্থি ছাত্র ইউনিয়নের দশম প্রাদেশিক সম্মেলন। ওই সম্মেলন উপলক্ষে পদার্থবিজ্ঞানের সহপাঠী আমরা রকেট ওড়াতে প্রচেষ্টা নিয়েছিলাম। সম্মেলনের উদ্বোধনীর তারিখে রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে জেলা-মহকুমার প্রতিনিধিদের সামনে আমরা রকেট উড়িয়ে দেখব, এটা ছিল আমাদের পণ। অনুমোদনও আমরা পেয়েছিলাম তখনকার ছাত্র ইউনিয়ন নেতাদের কাছ থেকে। চলল প্রযুক্তি আয়ত্ত করা ও রকেট বানানোর প্রস্তুতি। ঢাকা হলের একটি রুমকে বানানো হলো গবেষণাগার। ধোলাইখাল থেকে লোহার চোঙ্গা ও ঝালাই করা লোহার মাথা দিয়ে বানানো হলো রকেট। সে কি উত্তেজনা! প্রথমটি বানিয়ে নেয়া হলো ওই মাঠে পরীক্ষামূলকভাবে ওড়ানোর জন্য। প্রথমটাতে আগুনই ধরল না। দ্বিতীয়টিতে আগুন ধরল বটে। সেই রকেটটির নিচ দিয়ে বের হলো ধোঁয়া। কিন্তু আমাদের হতাশ করে দিয়ে ছুটে গেল সেই ঝালাই করা রকেটের মাথা। ইতোমধ্যে বাজেট আমাদের শেষ। সম্মেলনের সময় এসে গেছে। রকেট ওড়ানো নিয়ে হতাশ হওয়া ছাড়া তখন আর কিছুই করার ছিল না আমাদের।

রকেট আমাদের উড়ল না, তবে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান আমাদের উড়িয়ে নিয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হলে সোভিয়েত রাশিয়ার সহযোগিতায় আমরা কেবল শোষণমুক্ত দেশ নয়, উন্নত-সমৃদ্ধ রকেট ওড়ানোর মতো দেশ গড়তে পারব; সেই স্বপ্ন নিঃসন্দেহে তখন অবহেলিত-নিপীড়িত-নির্যাতিত জাতিকে আলোড়িত ও উদ্বুদ্ধ করেছিল। দেশবাসীর আকাক্সক্ষা বুঝে সম্পূর্ণ ধোঁকা দেয়ার জন্য ১৯৭০ সালের ৩ জানুয়ারি বেতবুনিয়ায় ফলক সর্বস্ব ভূউপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করলেন। কিন্তু আইয়ুব-ইয়াহিয়ার পথে নয়, বাঙালি এগিয়ে গেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পথ ধরে। দেশ হলো স্বাধীন। যুদ্ধে বিধ্বস্ত। কোটি শরণার্থী। নেই খাদ্য, বাসস্থান, পুল-রাস্তা, সমুদ্রবন্দর, টাকাপয়সা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কোনো কিছু। সেই কঠিন ও জটিল বিশ্ব ও ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত কবলিত জাতীয় পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা ছিল না বাঙালি জাতির। কিন্তু ছিল স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা। সেই দিকটি জাতির পিতার অগোচরে থাকার কথা নয়। তিনিই তো বাঙালির স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা ধারণ করে অবিসংবাদিত নেতা রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বেতবুনিয়া ভূউপগ্রহ কেন্দ্রটি চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়। ঘাতকের নিষ্ঠুর আঘাতে নিহত হওয়ার মাত্র ৬০ দিন আগে ১৪ জুন তিনি ওই ভূউপগ্রহ কেন্দ্রটি উদ্বোধন করেন।

আজ প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর কেন আমরা মহাকাশ জয়ের পথে বিন্দুমাত্র অগ্রসর হতে পারলাম না। জানা যায়, বেতবুনিয়া ভূউপগ্রহ কেন্দ্র পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর সরিয়ে নিতে চাওয়া হয়েছিল। কার্যত অচল ছিল কেন্দ্রটি। এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই আছে বঙ্গবন্ধ স্যাটেলাইটু-১ উপগ্রহ নিয়ে বিএনপির নেতাদের উল্টাপাল্টা হতাশা ও বিভ্রান্তিজনক কথাবার্তা। আমাদের মতোই ছাত্র ছিল বিএনপির মহাসচিব নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ষাটের দশকে তিনি ছিলেন চীনপন্থি। জানি না ছাত্র থাকাকালে তিনি জাতীয় কবির কবিতা পড়ে বা মানব জাতির মহাকাশ জয়ের গৌরব দেখে-শুনে তিনি আলোড়িত-উৎসাহিত হয়েছিলেন কিনা? নাকি এখনকার মতো তখনো ছিলেন অন্ধ ও সংকীর্ণ কিংবা ‘পাগল ও শিশু’। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমদুর রহমান মান্না অবশ্য ছাত্রজীবনে ছিলেন ছাত্রলীগ। নিশ্চয়ই তখন আকাশ জয়ের স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু এখন বিএনপি-জামায়াত জোট নেতা ফখরুলের সঙ্গী হতে গিয়ে অন্ধ হয়ে গেলেন তিনিও।

টাকার অঙ্কের লাভক্ষতির হিসাব করলে কি কখনো বিজ্ঞান চর্চা বা সৃজনশীল বা অনুসন্ধানমূলক কাজ করা সম্ভব? সফল ও ব্যর্থ হওয়ার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয় এমন ধরনের কাজ। এ সব নেতা যে বক্তৃতা দিচ্ছেন, টেলিভিশনের সময় নিচ্ছেন, পত্রিকার পাতা ভরছেন; তার লাভ-ক্ষতির হিসাব রাখবে কে? কোথায় দল-মত নির্বিশেষে উৎসাহ দিবে বাঙালির মহাকাশ অভিযানের সূচনায়, তা নয়, শুরু হয়েছে তীব্র সমালোচনা। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ যাত্রা প্রথমবারের মতো যদি ব্যর্থও হতো, তবুও জাতি মনে হয় সেই অভিযাত্রা থেকে পিছিয়ে আসত না। এদিকে আবার ওই অনুৎসাহী ও অপপ্রচারকারী গোষ্ঠী-মহল লাভক্ষতির সঙ্গে ব্যবসার প্রশ্ন তুলেছেন। বর্তমান দুনিয়ায় বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, অভিযাত্রা ব্যবসা-বাণিজ্য, পড়াশোনা প্রভৃতি সব কিছু একটা আর একটার সঙ্গে জড়িত হয়ে আছে। অন্ধ বা জাতে মাতাল তালে ঠিক হলে জাতির বহু দিনের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে ৫৭তম দেশ হিসেবে মহাকাশ বিজয়ে সরকার যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তা জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

শেখর দত্ত : রাজনীতিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App