×

পুরনো খবর

প্রাক-বাজেট কথন

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ১২ মে ২০১৮, ০৯:৫০ পিএম

বর্তমানে এ দেশে এ ধরনের বেকারের একটা বিরাট অংশ রয়েছে, এই বেকাররা অধিকাংশ নিম্ন-মধ্যবিত্ত হওয়ায় সরকারের ভিজিএফ ভিজিডি বা অন্য কোনো সহায়তা প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হতে পারছে না, ফলে চরম দরিদ্রতার মাঝে তাদের দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। সরকারের Social safety program এনজিওর চাকরিচ্যুত বেকারদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টা এ বাজেটে আসা প্রয়োজন।

২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে কি থাকবে, বাজেটে বা কি থাকা উচিত এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। বাজেটকে সরকার চায় গণমুখী করার। গণমুখী বাজেট উপস্থাপন করতে হলে জনগণের মতামতের প্রয়োজন রয়েছে, বাজেটে জনগণের মতামত যাতে করে প্রতিফলিত হয় তার জন্য সিভিল সোসাইটিও এফজিডি টাইপের কিছু আলোচনার ব্যবস্থা করে আসছে অনেকদিন ধরে। এই এফজিডি কর্তৃক নেয়া বহু সিদ্ধান্তই বাজেট তৈরিকারকদের কাছে অনেক সময় পৌঁছে না। তা ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোও প্রাক-বাজেটে কিছু বলার চেষ্টা করলেও তার দৃশ্যায়মান হতে তেমন একটা দেখা যায় না, তবে ঘোষিত বাজেটের ত্রুটিসমূহের নানা দিক নিয়ে সমালোচনা করে রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করেন, এই যুক্তিগুলোর পরবর্তী সময়ে অনেক কিছুই উপস্থাপিত বাজেটকে সংশোধন করে এবং পরিপূর্ণ বাজেট সংশোধন হয়ে পাস হয়।

বাজেট বিষয়টি নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে ধারণা দেয়ার জন্য অনেক এনজিও কাজ করছে। কিছু এনজিওর এই বাজেট কার্যক্রমটা জনগণকে বাজেট সম্পর্কে কতটা সাক্ষর করছে তা নিয়ে একটু ভাবার বিষয়। বিষয়টা হলো একজন মানুষ যদি বাজেট কি? কেন তা প্রস্তুত করা হয়? তা না জানে আর বাজেটের খাতগুলো কীভাবে বিন্যস্ত আর এ খাতওয়ারি বিভাগগুলো সম্পর্কে জনসাধারণের কতটুকু ধারণা আছে? এ বিষয়গুলো সম্পর্কে এনজিওরা কি সচেতনতামূলক কোনো কার্যক্রম করছে নাকি বাজেটে কি অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রয়োজন সে বিষয়ে মতামত নিচ্ছেন। যদি একজন মানুষ বাজেটের মৌলিক বিষয়টা না জানে তবে মূল বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা না নিয়ে মানুষের মুখে শুনে শুনে যে মতামত প্রদান করাটা কতটা যৌক্তিক। এনজিওদের এফজিডিতে আসা অংশ নেয়দের মধ্যে অনেকেরই বাজেটের মৌলিক ধারণাটা থাকে না। তারপরও সবার সঙ্গে এক হয়ে অংশগ্রহণকারীরা যে মতামতটা দেয় তা তৃণমূল মানুষের মতামত হিসেবে ধরে নেয়া হয়। তাই বিষয়টা আদৌ যৌক্তিক হয় না। তারপরও এ মতামতটাকেই তৃণমূলের মতামত হিসেবে ধরে নেয়া হয়।

সরকারের তৃণমূল কাঠামো হলো স্থানীয় সরকারগুলো। যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন এই স্থানীয় সরকারগুলো কতটা কার্যকরভাবে নিজস্ব বাজেট প্রণয়ন করতে পারছে। আর এই প্রণীত বাজেটকে বাস্তবায়ন করার জন্য তারা কতটা সক্ষম আর কতটা জাতীয় সরকার থেকে সহযোগিতা করতে হবে সে সব বিষয়টাও প্রাক-বাজেট কথনে আসা দরকার। জাতীয় বাজেটে উল্লিখিত সরকারসমূহের সক্ষমতা বাড়াতে কি পদক্ষেপ নেয়া হয় বা ভবিষ্যতে নেয়া দরকার তার একটি সঠিক দিকনির্দেশনা বাজেট সম্পর্কিত এফজিডিতে হওয়া উচিত। স্থানীয় সরকারগুলো উন্নয়ন কার্যক্রমের গতির ওপর নির্ভর করে জাতীয় উন্নয়ন। সুতরাং সরকারের উন্নয়নের মূল গতিটা প্রতিফলিত হয় তৃণমূলের উন্নয়নের সূচকের ওপর ভিত্তি করে। কোনো সমাজে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের ইতিবাচক উন্নয়ন ঘটেছে তা পরিমাপ করার সূচকগুলো পূরণ করার হয় তৃণমূল মানুষের অবস্থার ইতিবাচক উন্নতির নিরিখে। তাই বাজেটকে গণমুখী করতে হলে তৃণমূল সরকার ব্যবস্থায় উপস্থাপিত বাজেটকে কার্যকরী এবং শক্তিশালী করতে হবে। বাস্তবে দেশের স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের কার্যক্রমটা দেশের আমলারাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আমলাদের স্বাক্ষরিত চিঠিতেই জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধি ক্ষমতাচ্যুত হয়ে যান। তবে প্রশ্ন আসতে পারে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হওয়ার কারণে তার সব দোষ কি মাফ হয়ে যাবে? বা তিনি তো প্রতিনিধিত্বকালে অসততা বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারেন? এই প্রশ্নগুলোর বিষয়বস্তুটা দেশের স্বাধীন বিচার বিভাগের দেখা উচিত, আমলাদের নয়।

বিচার বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুসারে একজন জনপ্রতিনিধিকে ক্ষমতাচ্যুত করা আইনত উপযুক্ত ব্যবস্থা, তাই এতদ সম্পর্কিত সিদ্ধান্তটা বিচার বিভাগের নেয়া দরকার। একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বার উপজেলা নির্বাহী অফিসার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত যা একটি গণতান্ত্রিক দেশে শোভন নয়, ইউনিয়ন পরিষদ তার উন্নয়নমূলক কাজের বাজেট স্বাধীনভাবে করতে পারে না, এলাকার রাস্তাঘাট, পুল কালভার্ট নির্মাণ সব বিষয়ে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের আমলাদের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাই তৃণমূলের বাজেট ভাবনাটা জাতীয় স্তরে কতটা প্রতিফলিত হয় সে বিষয়টি নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। দেশে আমলা নির্ভরতা বাড়ছে ফলে জনমত প্রকাশের ক্ষেত্রগুলো ক্রমেই সঙ্কুচিত হচ্ছে, যা আমাদের মহান স্বাধীনতার মূল স্রোতধারা থেকে রাষ্ট্রীয় আদর্শকে বিচ্যুত করার একটা অপচেষ্টা। তৃণমূল পর্যায়ে প্রাক-বাজেট বিষয়ে যে আলোচনা হচ্ছে তাতে বাজেট সাক্ষরদের উপস্থিতি খুবই কম অনেক সময় এই অজুহাতেই তৃণমূলের মতামতটা বাজেটে প্রতিফলিত হয় না। ধনবাদী অর্থনীতির রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কিছু অজ্ঞ লোককে বাজেট এবং শাসনযন্ত্রের অন্যান্য বিষয়ে আলোচনায় নিয়ে আসা হয় অনেকটা কৌশল করে। আর এই কৌশলের পেছনের মূল ফোকাসটারও একটি অন্তর্নিহিত কারণ লুকায়িত আছে। এই অসাক্ষরদের আলোচনার বিষয়টি সমাজে এবং আন্তর্জাতিকভাবে এভাবে দেখানো হয় যে, বাজেটে সংক্রান্ত বিষয়ে সমাজের অনগ্রসর গোষ্ঠীর মতামত দিচ্ছি। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মতামত দেয়া মানে দেশের ইতিবাচক উন্নয়ন হয়েছে বলেই এই অনগ্রসর জনগোষ্ঠী বাজেট বিষয়ের ওপর মতামত দিতে পারছে। এ ধরনের কার্যক্রম একটি ইতিবাচক না এটা নেতিবাচক কার্যক্রম যা একটি গোষ্ঠীকেই শুধু লাভবান করে। এ ধরনের বাজেট বিষয়ক ব্যবস্থাটিতে অনাবশ্যক কার্যক্রম সংঘটিত করার পেছনে কলকাঠি নাড়ে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহ। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহ এনজিওগুলোকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করে, আর এনজিওগুলো বাজেট সম্পর্কিত বিষয়বস্তুতে বাজেট অসাক্ষরদের নিয়ে প্রাক-বাজেট পর্যালোচনায় রপ্ত হয়। এ ধরনের ব্যবস্থাটার মূল কারণটাই হলো বাজেট যাতে গণমুখী না হয়ে একটি গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে পারে। আর এ সব কারণে বাজেট আমলানির্ভর হয়ে পড়ে।

আমলানির্ভর বাজেটে সাধারণ জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন কম হয়। প্রতিটি বাজেট এখনো প্রস্তুত হয় আমলাতন্ত্রের কার্যালয়ে। বাজেট নাকি এখনো প্রস্তুত হয় আইএমএফ, বিশ^ব্যাংক বা বিদেশি কোনো দেশের পরামর্শে। যদি তাই হয় তাহলে কথিত তৃণমূলে ঘটা করে আয়োজিত প্রাক-বাজেট কতটা বাজেটকে প্রভাবিত করছে। পুরো বিষয়টা একটা আইওয়াশ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে নাকি সরকারি কর্মীদের মহার্ঘ্য ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা থাকবে। অল্প কিছুদিন আগে সরকারি কর্মীদের বেতন স্কেল দ্বিগুণ করা হয়েছে। দেশ মধ্যম আয়ের দিকে এগুচ্ছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে তাই কর বাড়াতে হবে এটা দেশের অর্থমন্ত্রীর গত কয়েক দিনের দেয়া বক্তব্যের সারসংক্ষেপ। আর এই কর বাড়িয়ে যদি মহার্ঘ্য ভাতা দেয়া হয় তাহলে বিষয়টি এই প্রবাদটির মতো রূপ নেবে। প্রবাদটি হলোÑ তেলি মাথায় মাখো তেল, ন্যাড়া মাথায় ভাঙো বেল। দেশে সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সব মিলে ৩০ লাখ মানুষ বিভিন্ন স্তরে চাকরি করছে। তাহলে কি দেশের মধ্যম আয়ের পথে এগিয়ে যাওয়ার সুফলটা সরকারি কর্মীরাই ভোগ করবে। মধ্যম আয়ের প্রাপ্তিটার ছিটেফোঁটাও সাধারণ জনগণ পাবে না। সাধারণ জনগণের ওপর শুধু করের বোঝাই বাড়বে? Social safety program এই সরকারের সবচেয়ে যুগান্তকরী পদক্ষেপ, তবে এই প্রোগ্রামে বেকারদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে। দেশের এনজিও কার্যক্রম অনেক কমে গেছে আর এই এনজিও কার্যক্রম কমে যাওয়ায় অনেক কর্মঠ ব্যক্তি চাকরি হারিয়েছেন, এর ফলে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। এনজিওর চাকরিচ্যুতরা শিক্ষিত বেকার। এ ধরনের বেড়ে যাওয়া বেকারদের মধ্যে অধিকাংশই ৪৫-৫৫ বয়সী। এ বয়সের বেকাররা অন্য কোথাও কাজের জন্য আবেদন করতে পারে না, অপরদিকে বয়সের কারণে নিজ উদ্যোগে নতুন কর্মসংস্থানটি গড়ে তোলাও তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।

বর্তমানে এ দেশে এ ধরনের বেকারের একটা বিরাট অংশ রয়েছে, এই বেকাররা অধিকাংশ নিম্ন-মধ্যবিত্ত হওয়ায় সরকারের ভিজিএফ ভিজিডি বা অন্য কোনো সহায়তা প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হতে পারছে না, ফলে চরম দরিদ্রতার মাঝে তাদের দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। সরকারের Social safety program এনজিওর চাকরিচ্যুত বেকারদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টা এ বাজেটে আসা প্রয়োজন। বিধবা, বয়স্ক, অন্যান্য অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে যেমন মাসিক ভাতা দেয়া হয় ঠিক তেমনই এই মধ্যবয়সী বেকারদেরও ভাতা দেয়ার দরকার। কারণ এ বেকাররাও পরিবার পরিজন নিয়ে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবনযাপন করছে। বাজেটকে গণমুখী করতে হলে সরকারি কর্মীদের বেতন না বাড়িয়ে ঝড়পরধষ ংধভবঃু ঢ়ৎড়মৎধস এর আওতা বাড়াতে হবে।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App