×

মুক্তচিন্তা

নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ মে ২০১৮, ০৭:২০ পিএম

জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) মোট ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৫নং ধারা হলো ‘লিঙ্গ সমতা অর্জন এবং সব নারীর ক্ষমতায়ন’। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের অগ্রগতি অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় সন্তোষজনক। পর্যাপ্ত সুযোগ, সুবিধা এবং সহায়তা পেলে বাংলাদেশের নারীরা শুধু উপমহাদেশ নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে।

উপমহাদেশের নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান অন্যান্য দেশের তুলনায় সন্তোষজনক পর্যায়ে রয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের নারীদের অবস্থান উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের তুলনায় ভালো অবস্থানে রয়েছে। হাজারো প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দেশের নারীরা থেমে নেই, এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে।

২০১৬ সালের জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন বিষয়ক একটি প্রতিবেদনে লক্ষ করা যায় বাংলাদেশের নারীদের গড় আয় এবং আয়ু প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। ক্রয় সক্ষমতা (পিপিপি) অনুসারে বাংলাদেশের নারীদের গড় আয় বছরে ২ হাজার ৩৭৯ ডলার বা বাংলাদেশি টাকায় ১ লাখ ৯২ হাজার ৬৯৯ টাকা। ভারতের নারীদের গড় আয় বছরে ২ হাজার ১৮৪ ডলার বা বাংলাদেশি টাকায় ১ লাখ ৭৬ হাজার ৯০৪ টাকা। পাকিস্তানের নারীদের গড় আয় বছরে ১ হাজার ৪৯৮ ডলার বা বাংলাদেশি টাকায় ১ লাখ ২১ হাজার ৩৩৮ টাকা। শুধু আয়ের দিক থেকে নয়, গড় আয়ু-শিশুর অপুষ্টি-শিশুমৃত্যু হার-চাকরির নিশ্চয়তার সূচকেও ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেয়া ২০১৫ সালের একটি হিসাব মতে, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বর্তমানে ৭২ বছর যেখানে ভারত ও পাকিস্তানের মানুষের গড় আয়ু যথাক্রমে ৬৮ দশমিক ৩ বছর এবং ৬৬ দশমিক ৪ বছর। ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে বাংলাদেশের শিশুরাই সবচেয়ে কম অপুষ্টির শিকার যেখানে ভারতে শতকে ৩৯ জন এবং পাকিস্তানে ৪৫ জন শিশু অপুষ্টিতে আক্রান্ত। (৮ নভেম্বর ২০১৭, প্রথম আলো)

আয় বৈষম্যের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। সবচেয়ে বেশি আয় বৈষম্যের শিকার হয় মানুষ ভারতে এবং সবচেয়ে কম আয় বৈষম্যের শিকার হয় পাকিস্তানে। বিশ্বব্যাংকের নতুন হিসাব অনুযায়ী হিসাব করলে দেখা যায়, ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কম। বিশ্বব্যাংকের ২০১৪ সালের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে, ভারতে এই হার ২১ দশমিক ২ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ৬ দশমিক ১ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে, ভারত এবং বাংলাদেশের তুলনায় পাকিস্তানের অবস্থান এ ক্ষেত্রে সন্তোষজনক।

তৈরি পোশাক শিল্প খাতে দেশের অধিকাংশ নারীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে যা অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের নারীদের এগিয়ে রাখতে ভূমিকা রেখেছে। তা ছাড়া বিগত কয়েক দশকে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি বেড়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে, যার ফলে নিশ্চিতকরণ সম্ভব হয়েছে অধিকাংশ নারীর কর্মসংস্থান। অধিক কর্মসংস্থানের ফলেই হ্রাস পেয়েছে দারিদ্র্য এবং বৃদ্ধি পেয়েছে আয়। বিগত কয়েক দশকে কৃষি খাতের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ এবং বৃদ্ধি পেয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতির পরিধি। স্বাস্থ্য খাতে ম্যালেরিয়া, কলেরার মতো কঠিন রোগ দূর করার ফলে হ্রাস পেয়েছে মৃত্যুহার।

নারীর ক্ষমতায়ন এবং লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে বর্তমান সরকার এবং এরই ফলে অর্জন করা সম্ভব হয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অর্জন। প্রত্যেক অর্থবছরে মোট বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নারী উন্নয়নের কাজে বরাদ্দ করা হয় এবং প্রত্যেক অর্থবছরে তা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে নারী উন্নয়নে মোট বাজেটের পরিমাণ ছিল ২৭ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে জেন্ডার বাজেটে ১০টি মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ২২১ কোটি টাকা; ২০১১-১২ অর্থবছরে ২০টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৪২ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা; ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২৫টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৫৪ হাজার ৩০২ কোটি টাকা এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪০টি মন্ত্রণালয়কে অন্তর্ভুক্ত করে জেন্ডার বাজেট ঘোষণা করা হয়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এই ৪০টি মন্ত্রণালয়কে অন্তর্ভুক্ত করে ৬৪ হাজার ৮৭ কোটি টাকা এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৭১ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা নারী উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ করা হয়।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে নারী উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ হয় মোট ৯২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা; যা ছিল বরাদ্দকৃত মোট বাজেটের ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে, বাজেটে নারী উন্নয়ন খাতে বাজেটের পরিমাণ প্রত্যেক অর্থবছরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ছে এবং জাতীয় পর্যায়ে বিষয়টি ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। (৩ জুন ২০১৬, বাংলা ট্রিবিউন)

সর্বশেষ ঘোষিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪০টি মন্ত্রণালয় থেকে ৪৩টিতে বর্ধিত করে ঘোষণা করা হয়েছে জেন্ডার বাজেট। বর্তমান অর্থবছরে নারী উন্নয়নে বরাদ্দকৃত বাজেটের পরিমাণ ১ লাখ ১২ হাজার ১৯ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় ২৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ এবং জিডিপির প্রায় ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। বাজেটকে মূলত তিনটি অংশে বিভক্ত করে নারী উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর মধ্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় হয় নারী উন্নয়নে।

জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) মোট ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৫নং ধারা হলো ‘লিঙ্গ সমতা অর্জন এবং সব নারীর ক্ষমতায়ন’। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের অগ্রগতি অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় সন্তোষজনক। পর্যাপ্ত সুযোগ, সুবিধা এবং সহায়তা পেলে বাংলাদেশের নারীরা শুধু উপমহাদেশ নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে।

ফাহিম আহমেদ : রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App