×

মুক্তচিন্তা

বর্ষভাবনা-১৪২৫

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০১৮, ০৯:৫৮ পিএম

বর্ষভাবনা-১৪২৫
বর্ষভাবনা-১৪২৫

স্বাধীন বাংলাদেশের বাঙালি দুই নববর্ষ অর্থাৎ খ্রিস্টীয় ও বঙ্গীয় তথা জানুয়ারি ও বৈশাখ কেন্দ্রিক বর্ষ অনুষ্ঠানে অভ্যস্ত হলেও রাজধানী ঢাকার তপ্ত দাবদাহে বৈশাখী নববর্ষই মহাসমারোহে পালিত হয়। এ বিষয় নিয়ে লেখালেখিও কম নয়, মূলত এর জাতীয়তাবাদী চেতনাকে কেন্দ্র করে। যদিও সে জাতীয়তা শ্রেণিভিত্তিক ও শ্রেণি বিশেষের। উৎসব অনুষ্ঠানে সেই বিশেষ শ্রেণির তরুণ ও যুবসমাজেরই একচেটিয়া প্রাধান্য। নববর্ষ পালন এবং এর আনুষ্ঠানিক উদযাপন চারিত্র্যবিচারে বিশ^জনীন। প্রাচ্যদেশীয়দের তুলনায় আধুনিক পাশ্চাত্যের মানুষ অনেক বেশি যুক্তিবাদী, বিষয়বাদী এবং জাগতিক চেতনায় গভীরভাবে আস্থাশীল। বিশাল প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে তাদের জীবন আবর্তিত, অর্থনীতির প্রভাবও একই মাত্রায় প্রকট।

তা সত্ত্বে নববর্ষের উৎসব অনুষ্ঠানে তাদের সংশ্লিষ্টতা কম নয়, কিছুটা হলেও আবেগের প্রকাশ তাতে রয়েছে। মূলত ঐতিহ্য সূত্রে ও সেই ধারাবাহিকতায় তাদের নববর্ষ উদযাপন। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, তারা নববর্ষের অনুষ্ঠানে অপেক্ষাকৃত উত্তম নববর্ষের সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে তাকে স্বাগত জানায় আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে। এর মধ্যে জাগতিক চেতনার প্রকাশই হয়তো প্রধান। তবু উৎসব বলে কথা।

বিলেতি বিশ্ব কোষেও নববর্ষের ব্যাখ্যা ও তাৎপর্যের বিষয়টি প্রায় একই রকম। তাদের মতে, নতুন বছরের আগমন সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর কাছে নতুন করে শ্রী, সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধির সম্ভাবনাময় বার্তা বহন করে। মনে হয়, এ যেন সময়ের নবজন্ম, হোক তা এক বছর বিশেষকে কেন্দ্র করে। নতুন মানেই ভালো কিছু, স্বপ্ন বা প্রত্যাশা। এই নতুনের মধ্যে আমরা নিজেদের নতুন করে দেখতে চাই, পেতে চাই ইত্যাদি।

এসব কথা, যদিও বিনোদনের প্রেক্ষাপটে, তবু তাতে রয়েছে রোমান্টিক দার্শনিকতা, বুদ্ধিবৃত্তিক কথকতা বা সাংস্কৃতিক রোমান্টিসিজম। জাগতিক চিন্তার মানুষ বরং বলতে পারেন এসব কথা একটু বাড়াবাড়ি নয় কি। বিনোদনে মিষ্টিমুখেই তো নতুনকে স্বাগত জানানো- ‘শুভ নববর্ষ’ এই বাক্যের পারস্পরিক উচ্চারণে। বাস্তব সত্যটা হলো আমরা জীবনযাপনের লাগাতার ক্লান্তির মধ্যে কোনো না কোনো উপলক্ষে এক চিলতে আনন্দ-উৎসবের উপভোগ্যতা খুঁজে পেতে চাই। নববর্ষ আমাদের তেমন একটি উপলক্ষ উপহার দেয়।

দুই. নববর্ষ উদযাপনের বস্তুত দুটো বিপরীত দিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বড় সত্য। নতুন বছরের সূচনা মানেই যেমন নতুনের সম্ভাবনা, তেমনি বিগত বছরের ভালোমন্দের সালতামামি। বস্তুবাদী মানুষ মাত্রেরই প্রথম মনে হবে, কেমন গেল গত বছরের দিনগুলো- জীবনখাতার পাতার হিসাবে। যেমন ব্যক্তিজীবনের, পারিবারিক জীবনের তেমনি সমষ্টিগত অর্থাৎ সামাজিক জীবনের ক্ষেত্রে, যেখানে অর্থনৈতিক বিবেচনা বড় একটি বিষয়।

কেমন গেল আমাদের গত বছরটি? রাজধানী ঢাকায় বসবাস করে এ বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা কী বলে? কী বার্তা জানায় সংবাদপত্রের খবর পরিবেশন ও প্রতিবেদন? দৈনিক শিরোনামগুলো আমাদের জানিয়ে দেয় দুই বিপরীত ধারার বিষয়টি। একদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (যা নিয়ে আবার কোনো কোনো অর্থনীতিবিদদের ভিন্নমত), কোনো কোনো খাতে উন্নতি, যোগাযোগ খাতে নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন- এক কথায় শাসনযন্ত্রের ভাষায় উন্নয়ন বছরটির বৈশিষ্ট্য।

দেশটিকে অর্থনৈতিক বিচারে মধ্যম আয়ের ভূখণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করার সম্ভাবনা নিয়ে চলছে অনেক কথকতা- নেপথ্যে বিশ্ব অর্থনীতির ইশারা। এ বছরটা নির্বাচনের বলেই উন্নয়নের বিষয়টি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যথেষ্ট কথাকাটাকাটি। উন্নয়নের পক্ষ দলে ভারী। তাদের পেছনে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থার হিসাব-নিকাশ।

কিন্তু সমস্যা হলো ঘটনা প্রায়শ এক ধারায় বয়ে চলে না। ভাঙাগড়া তার স্বভাব, সে স্বভাবের ধারাবাহিকতা নিয়ে তার চলা অনেকটা নদীর মতো সময়ও এক অর্থে বহতা নদী। সে তার ভালো-মন্দ নিয়ে এগিয়ে চলে, থামতে জানে না। কবির ভাষায় সময় এক ‘বৃদ্ধ যাযাবর’।

সময়ের এ ধারাবাহিকতায় গত চার/সাড়ে চার দশকে আমাদের সামাজিক জীবন, বহু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, আবার তা কেটে গিয়েছে নতুন সমস্যার আবির্ভাবে। সমাজ-বিশ্লেষকরা তাদের ব্যাখ্যা বিচারে এসব পরিস্থিতির জন্য শাসন ব্যবস্থাকে দায়ী করে থাকেন তাদের জরিপভিত্তিক উপাত্ত তুলে ধরে কিংবা নিছক তাত্তি¡ক বিচারে।

আর সাধারণ মানুষের কাছে যেসব জটিলতার উপলব্ধি তাদের সহজ-সরল প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার হিসাবে। ছোট্ট দুয়েকটি উদাহরণ সবার অভিজ্ঞতাকেই স্পর্শ করবে। যেমন গত বছরে বাঙালির প্রদান খাদ্য উপকরণ চালের দাম নিয়ে ব্যবসায়ীকুলের ব্যাপক মুনাফাবাজি- কেজি প্রতি চালের দাম এক লাফে আট থেকে দশ টাকা বৃদ্ধি যা শ্রমজীবী মানুষ থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকেও ছেঁকা দিয়ে চলেছে, এখনো দিচ্ছে। সরকারের চেষ্টা বিশেষ ফলপ্রসূ হয়নি। এতে নাকি মুনাফাবাজ সিন্ডিকেটের ২২ হাজার কোটি বাড়তি টাকা আয়। তেমনি অবিশ্বাস্য ঘটনা হঠাৎ করেই আরো দুটো দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় উপাদান পেঁয়াজ ও কাঁচামরিচের দাম উন্মাদের মতোই আকাশমুখী, যথাক্রমে কেজি প্রতি ৪০ টাকা থেকে ১০০ টাকা এবং পরেরটি ২৫ টাকা থেকে ২০০ টাকা, কমে গিয়ে ১০০ টাকা। এমন ঘটনা প্রতি বছর রমজান মাসে এবং দুই ঈদ উৎসব উপলক্ষে দেখা যায় কোনো না কোনো উপকরণ নিয়ে। এ ধারা নিয়মিত চলছে।

বৃহৎ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এত শক্তিশালী যে শাসন ব্যবস্থার সাধ্য কি তাকে স্বাভাবিক মাত্রায় ধরে রাখে। এ দুর্বলতার পেছনে সক্রিয় পরস্পরের স্বার্থের হিসাব-নিকাশ- এমটাই অর্থনীতিবিদ বিশ্লেষকদের দাবি। যেখানে সরকারের মুখ্য বক্তব্য মানুষের মাথাপিছু আয় তথা ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। কথাটা সত্য। তবে তা প্রতিদিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ, কতটা গ্রহণযোগ্য, শুভঙ্করের যে ফাঁকি কেউ বিবেচনায় আনেন না। এটাতো সাধারণ মানুষের হিসাব। আর বিশেষজ্ঞদের হিসাব ভিন্নমাত্রায় হলেও মূল বিষয়টি একই রকম। তারা হিসাব করেন আয়ের পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ আঘাত এবং অনুরূপ সূচকগুলো নিয়ে। তাদের অবশেষ সিদ্ধান্ত : উন্নয়নকে গ্রাস করছে নেতিবাচক সূচকগুলো যা মানুষের দৈনন্দিন জীবন স্পর্শ করে চলেছে, সে স্পর্শ অনাকাক্সিক্ষত ও নেতিবাচক ধারায়। তাদের বিচার-বিবেচনায় জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছেন না সরকার; কেউ বলছেন ‘দেশ ঠিক পথে চলছে না; কারো মতে উন্নয়নের তুলনায় পতনের প্রবণতা অধিক’ ইত্যাদি। অন্যদিকে বিদ্যুৎ নিয়ে, জ¦ালানি তেলের মূল্য হ্রাস না করা নিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির যথেষ্ট অভিযোগ। শুধু অভিযোগ নেই বিত্তবান ও পুঁজিপতি শ্রেণির। তবু তাদের দাবি, তাদের মুনাফার পথটা আরো মানে ও সহজ করা হোক।

সাহিত্য-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে শিক্ষিত শ্রেণির আত্মতৃপ্তির কারণ থাকলেও গত বছর শিক্ষাক্ষেত্রে চরম অনৈতিক বিস্ফোরণ অর্থাৎ ক্রমাগত প্রশ্নপত্র ফাঁস ও কোচিং বাণিজ্যের প্রবলতা সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করে চলেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর চরম ব্যর্থতার পরিচয় রেখেছে এসব ক্ষেত্রে। কোনো চিকিৎসাক্ষেত্রেই রোগ নিরাময় হচ্ছে না। তদুপরি বাড়তি উপদ্রব শিক্ষাতান্ত্রিক পাঠ্যবিষয়ে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের অনুপ্রবেশ। সেখানে সাম্প্রদায়িকতার দূষণ নতুন মাত্রা অর্জন করেছে যা রাষ্ট্রীয় নীতির লঙ্ঘন বললে অত্যুক্তি হয় না।

শিক্ষার মান, শিক্ষকতার মান নিম্নমুখী হওয়ার কারণে শিক্ষায় মননশীলতার ও মেধার ক্রমাবনতি। জাতিগত উৎকর্ষ বিচারে গোটা বিষয়টিই নেতিবাচক পরিণতির পরিচায়ক। তবে এসব কিছু দাঁড়িয়ে গেছে মানুষের নিরাপত্তার অভাব, গুম, খুনের প্রবণতা, চরম অনৈতিকতার প্রকাশ নারী নির্যাতন, শিশুকন্যা নির্যাতনের ব্যাপকতা ও প্রবণতায়, যা প্রতিদিন দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম। নারী নিরাপত্তা সর্বাধিক বিঘ্নিত। শিক্ষায়তনে, চলতি বাসে, পথেঘাটে মৃগয়াবিনাশী বিত্তবান পরিবারের সন্তানরা সমাজে ব্যাধির প্রসার ঘটিয়ে চলেছে। ক্রমান্বয়ে সংঘটিত অনেকগুলো ঘটনা দুষ্টক্ষতের মতো সমাজকে দূষিত বিষাক্ত করছে, প্রতিকার-প্রতিরোধ বা চিকিৎসার ব্যবস্থা অপ্রতুল বা অকার্যকর। রাজধানী ঢাকা থেকে শহরে-গঞ্জে ও বীভৎস আচরণের বিস্তার। এ অবস্থা কোনো সভ্য সমাজের পরিচয় বহন করে না।

তিন. গত বছরটি (২০১৭) এমন এক দূষিত, ক্ষতবিক্ষত সামাজিক চরিত্র নিয়ে শেষ হয়েছে। বিদায় নিয়েছে রাজনীতি সচেতন মানুষের মনে ক্ষোভ, যন্ত্রণা, বিরূপতা ও নেতিবাচক অনুভূতি সৃষ্টি করে। এর আগে দেখা গেছে বিরোধীদলীয় সামাজিক-রাজনৈতিক সন্ত্রাসে আতঙ্কে আর মৃত্যুর ঘটনা বাসে আগুন, পেট্রল বোমায় অসহায় মৃত্যু, অগ্নিদগ্ধ নিরীহ মানুষ অসহায় যন্ত্রণায় কাতর। এসব কি ভালো থাকার নিদর্শন? রাজনৈতিক-সামাজিক নৈরাজ্য জনমানসে হতাশা সৃষ্টি করে চলেছে। অবশ্য এরা মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত শ্রেণি ও নিম্নবর্গীয় মানুষ, যাদের চোখেও একাত্তর স্বপ্ন ছড়িয়ে দিয়েছিল অবিশ্বাস্য পাকিস্তানি বর্বরতার পরিপ্রেক্ষিতে। সে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পেতে পেতেও হারিয়ে গেছে। এখন তা পুনরুদ্ধারের পালা। এমন প্রতাশা এখনো মানুষের মনে।

স্বভাবতই প্রশ্ন : কেমন হবে আগামী বছরটি? চলমান বছরে কি ক্ষতগুলো নিরাময়ের পথ ধরবে, না কি তা একইভাবে চলবে কিংবা এর অবনতি ঘটবে? সত্যি বলতে কি প্রত্যাশার মুখ তো সর্বদাই সোনালি ও উজ্জ্বল। সুশাসনের সদিচ্ছা অবশ্যই কিছু না কিছু অগ্রগতির পথরেখা তৈরি করতে পারে। অনাকাক্সিক্ষত অভিজ্ঞতা থেকে, দুঃস্বপ্ন থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়।

বৈশাখী নববর্ষের তথা শুভ নববর্ষের আবেগ ও আকাক্সক্ষা আমাদের সবাইকে তেমন একটি সুশ্রী সময়-বিন্দুতে পৌঁছে দিক এমন ভাবনা এ দিনটিতে নিশ্চয়ই আমাদের সবারই। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নেতিবাচক দিকগুলোকেও দূর করে সুশ্রী সময়ের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করুক।

আমাদের প্রত্যাশা এই বছরটা শুচি স্নিগ্ধতায় যেন পরিচ্ছন্ন হয়ে ওঠে, মানুষের প্রত্যাশার পূরণ ঘটে।

আহমদ রফিক : ভাষা সংগ্রামী ও গবেষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App