×

মুক্তচিন্তা

রাজনীতির মানোন্নয়নের জন্য ভাবনা

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০১৮, ০৬:২১ পিএম

সুষ্ঠু নির্বাচন আমরা চাই। কিন্তু কেবল সুষ্ঠু নির্বাচনে আমাদের জাতির রাজনৈতিক চিন্তাকে সম্পূর্ণ সীমাবদ্ধ রাখা একেবারেই উচিত নয়। দেশের বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করা, মত প্রকাশ করা এবং কাজ করা দরকার। চিন্তা ও কাজের নতুন কেন্দ্র সৃষ্টি করতে হবে।

বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে। তার আগে আগামী ডিসেম্বরে নতুন সরকার গঠনের জন্য জাতীয় সংসদের নির্বাচন হওয়ার কথা। নির্বাচন কমিশন ওই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি প্রভৃতি দল নির্বাচন সামনে নিয়ে নিজেদের অবস্থান ও অবস্থা শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। ছোট দলগুলোও নড়াচড়া করছে। সিভিল সোসাইটি অরগানাইজেশনগুলোর বিশিষ্ট নাগরিকরা কষ্ট করছেন যাতে সব দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সমান সুযোগ সৃষ্টি করা হয় এবং নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয়।

বাংলাদেশের রাজনীতির বিষয়ে দেশে-বিদেশে যেসব আলোচনা চলে, সেগুলো লক্ষ করলে মনে হয়, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানই বাংলাদেশের মূল সমস্যা। এই রকম চিন্তা এবং এর পেছনে যে দৃষ্টিভঙ্গি বিরাজ করছে তা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয়, জাতীয় ও সামাজিক সমস্যার সমাধানের জন্য মোটেই অনুকূল নয়। বিচার-বিবেচনায় গেলে দেখা যায়, আমাদের রাষ্ট্র এখনো গড়েই ওঠেনি। জাতি হওয়ার জন্য জনজীবনে যে ঐক্যবোধ এবং জাতীয় চেতনা দরকার, বাংলাদেশে তা নেই। জনগণ ভীষণভাবে অনৈক্যের মধ্যে আছে। জাতীয় সংস্কৃতি বিষয়ে এত প্রবলভাবে সক্রিয় পরস্পর-বিরোধী দুই মত নিয়ে জাতি হয় না।

বাংলাদেশের প্রধান দুই দল গণতন্ত্রের দাবি নিয়ে দেশের জনগণের কাছে না গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রের স্থানীয় দূতাবাসগুলোতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্কে ছোটাছুটি করেন। শাসকশ্রেণির লোকেরা দল-মত নির্বিশেষে, তাদের ছেলেমেয়েদের যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রের নাগরিক করে চলছেন। কেউ কেউ নিজেরাও ওইসব রাষ্ট্রে নাগরিক হয়ে আছেন। প্রবাসীদের ভোটার করার জন্য সিভিল সোসাইটি অরগানাইজেশনগুলো কয়েক বছর ধরে দাবি তুলছে। প্রবাসী কারা? যারা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রে গিয়ে নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন তারা? যে অবস্থা বিরাজ করছে এবং যে রাজনীতি চলছে, তা নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠবে? বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির লোকেরা (সব দলের) কি রাষ্ট্র-গঠনের মনোযোগী। গুরুতর আরো অনেক প্রশ্ন আছে।

যে নির্বাচন সামনে আসছে, তা যত ভালোভাবেই অনুষ্ঠিত হোক এবং যে দলই ক্ষমতায় আসুক, তা দ্বারা আমাদের রাষ্ট্রীয়, জাতীয় ও সামাজিক গুরুতর কোনো সমস্যারই সমাধান হবে না। আমার মত সর্বজনস্বীকৃত হওয়ার কথা। এখানে এ নিয়ে যুক্তি প্রদর্শনে যেতে চাই না। আমার বক্তব্য এই যে, গতানুগতিক রাজনৈতিক চিন্তার বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে হবে, রাজনীতির মান উন্নত করার জন্য চিন্তা ও কর্মের নতুন ধারা সৃষ্টি করতে হবে। Status quo--তে পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন ঘটাতে হবে। কোনো প্রচারমাধ্যম-পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল- এ ব্যাপারে সহায়ক নয়। সব প্রচারমাধ্যমই প্রবলভাবে গতানুগতির Status quo-এর পক্ষে। ফেসবুক ও অনলাইন একটি ডিটিজ আছে, তবে সেগুলো দ্বারা চিন্তার ও কর্মের অভিপ্রেত নতুন ধারা সৃষ্টি সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। চিন্তা ও কাজের কার্যকর কোনো নতুন ধারা সৃষ্টি হলে অনলাইন একটি ডিটিজ তার সহায়ক হবে। তবে প্রগতিবিরোধী ধারাও তাতে সক্রিয় থাকবে। আস্তিকতা- নাস্তিকতা নিয়ে যে বিতর্ক তার কোনো সুফল খুঁজে পাওয়া যায় না।

আমাদের রাষ্ট্র, জাতি ও সমাজের উন্নতির জন্য যে রাজনীতি দরকার, তার জন্য কিছু কাজের কথা এখানে উল্লেখ করছি। সুষ্ঠু নির্বাচন আমরা চাই। কিন্তু কেবল সুষ্ঠু নির্বাচনে আমাদের জাতির রাজনৈতিক চিন্তাকে সম্পূর্ণ সীমাবদ্ধ রাখা একেবারেই উচিত নয়। দেশের বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করা, মত প্রকাশ করা এবং কাজ করা দরকার। চিন্তা ও কাজের নতুন কেন্দ্র সৃষ্টি করতে হবে।

আদর্শগত প্রস্তুতির জন্য আন্দোলন দরকার। আন্দোলন চলতে এখানে চিন্তাগত আন্দোলন, বৌদ্ধিক আন্দোলন বুঝাচ্ছি। সংঘাত-সংঘর্ষের আন্দোলন নয়। বর্তমানে যে অবস্থা বাংলাদেশে এবং গোটা পৃথিবীতে বিরাজ করছে তাতে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, মার্কসবাদ ইত্যাদি আদর্শকে বাস্তবে সম্পূর্ণ অন্তঃসারশূন্য ও গণবিরোধী করে ফেলা হয়েছে। এসব আদর্শ এখন কায়েমি স্বার্থবাদীদের দ্বারা জনস্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের জায়গায় বিশ্বায়ন নামে যে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ গণবিরোধী। এই বাস্তবতার মধ্যে পুনরায় পরাজিত সব সংস্কার-বিশ্বাস ও ধর্ম পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে। আজ দরকার ধর্মকে ইতিহাসের ধারায় পক্ষপাতমুক্ত, অনুরাগ ও বিরাগমুক্ত মন নিয়ে বোঝা। সেইসঙ্গে একইভাবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদকে ইতিহাসের ধারায় গভীরভাবে বোঝা দরকার। বোঝা দরকার সংশ্লেষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গণতন্ত্রের আদর্শকে সর্বজনীন গণতন্ত্র রূপে বিকশিত করা। জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদকেও ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমান বাস্তবতা বিচার করে নতুনভাবে বোঝা দরকার। সর্বজনীন গণতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ অবলম্বন করে জাতি, রাষ্ট্র ও নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সর্বজনীন গণতন্ত্রে দলভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সরকার গঠন করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে জ্ঞানগত প্রস্তুতি চালিয়ে যেতে হবে। প্রতিটি বিষয়কে গভীরভাবে বুঝে কাজ করতে হবে। যেভাবে বাংলাদেশ চলছে তা চলতে থাকলে পুরনো সংস্কার-বিশ্বাসের ও ধর্মীয় শক্তির রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা অনিবার্য।

দল গঠনে গুরুত্ব দিতে হবে। তার জন্য দলে সর্বজনীন গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদি বিষয়ে দলের নেতাকর্মীদের গভীর অধ্যয়ন ও চিন্তাচর্চা দরকার। দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক সংগঠন-পদ্ধতি ও শৃঙ্খলা অপরিহার্য। দলের ভেতরকার শৃঙ্খলা ও কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে দলের নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক চরিত্র উন্নত করতে হবে। উন্নত জ্ঞান ও উন্নত চরিত্রবলসম্পন্ন ব্যক্তিদের নেতৃত্বে আসীন করতে হবে। টাকার ও পেশিশক্তির ওপর উন্নত চরিত্রবলকে স্থান দিতে হবে। এসব বিবেচনা করলে বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না যে, আওয়ামী লীগ, বিএনপি প্রভৃতি দল রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠেনি।

বৌদ্ধিকচর্চার মধ্য দিয়ে নবযুগের নতুন রেনেসাঁস সৃষ্টির জন্য বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের সংখ্যায় তারা যত কমই হোনÑ ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ আরম্ভ করতে হবে।

দরকার ভালো বই পড়া এবং পাঠ-আন্দোলন (study movement) গড়ে তোলা। ভালো বই সংখ্যায় কম। ভালো বই ভালো করে পড়তে সময় বেশি লাগে। অনেক বই পড়ার চেয়ে কমসংখ্যক ভালো বই পড়া অনেক বেশি কল্যাণকর। ঢাকাকেন্দ্রিক জাতীয় সংস্কৃতিতে রাজনীতির উন্নতির জন্য যাদের বই রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অবশ্য পড়া উচিত তারা হলেন- মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আবুল ফজল, আহমদ শরীফ, বদরুদ্দীন উমর, আহমদ রফিক, যতীন সরকার প্রমুখ। আরো অনেক চিন্তাশীল লেখকদের বই পড়তে হবে। তা ছাড়া আছে গল্প-উপন্যাস, কবিতা, নাটক ইত্যাদি। পড়া উচিত বিশ্লেষণমূলক ও বিচারমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, দরকার জাতীয় সংস্কৃতিতে চিন্তাচর্চা ও স্বাধীন চিন্তাশীলতা। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা এবং শিক্ষিত লোকেরা যদি কিছু পরিমাণেও ভালো বই পড়েন, পড়ার মতো করে পড়েন, তাহলে অবশ্যই রাজনীতির মান উন্নত হবে। সঙ্কীর্ণতা, হীন-স্বার্থবুদ্ধি, উগ্রদলীয় মানসিকতা পরিহার করতে হবে। বই পড়ার জন্য গ্রামে ও শহরে দেশব্যাপী পাঠকেন্দ্র ও পাঠ আন্দোলন সৃষ্টি করা দরকার।

ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, চীন বিপ্লব, ভারত বর্ষের ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রাম, গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি সম্পর্কে প্রভূত জ্ঞান দরকার।

এনজিও ও সিভিল সোসাইটি মহল থেকে যেসব কথা নিরন্তর প্রচার করা হয় সেগুলো সম্পর্কে দরকার ব্যাপক ও গভীর সচেতনতা। তাদের প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করে বাংলাদেশ কোনোকালেই কোনো অবস্থাতেই উঠতে পারবে না। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা নীতি অনুযায়ী বাংলাদেশকে নির্ভরশীল রাখার জন্য তারা কাজ করে।

যে ধারায় চিন্তা ও কাজ করার কথা এখানে আমি উল্লেখ করলাম, দেশের অতি স্বল্প সংখ্যক বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তি যদি সে ধারায় চিন্তা করেন এবং মত প্রকাশ করতে থাকেন তাহলে তারা নতুন ইতিহাস সৃষ্টির অগ্রপথিক।

আবুল কাসেম ফজলুল হক : সৃজনশীল চিন্তক, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App