×

মুক্তচিন্তা

প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতি ও প্রতিবন্ধকতা

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০১৮, ০৬:১২ পিএম

বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের পদক্ষেপে বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো জাতীয়করণ করা হয়েছে। আর পে-স্কেল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের বেতনও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই শিক্ষকদের আন্তরিকতাও আরো একটু বৃদ্ধি করতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ওপর আস্থা এবং কিন্ডার গার্টেন নির্ভর শিক্ষার প্রভাব কমাতে শিক্ষকদেরই এগিয়ে আসতে হবে। তাদের আন্তরিক হতে হবে এবং নিজেদের প্রমাণ করতে হবে।

প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষাস্তরের প্রাথমিক ধাপ। সব ধরনের যুগোপযোগী পদক্ষেপ নেয়ার পরও আজ পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা কাক্সিক্ষত অগ্রগতি লাভ করতে পারেনি। অন্যদিকে দেশে অলিতে-গলিতে, বিল্ডিংয়ের কোনায় ব্যাঙের ছাতার মতো কিন্ডার গার্টেন গড়ে উঠছে। এসব হাজার হাজার কিন্ডার গার্টেন নিয়ন্ত্রণে কোনো নজরদারি নেই। যেখানে যেমন ইচ্ছা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি বহু আইন এসব কিন্ডার গার্টেনে উপেক্ষিত। উপেক্ষিত হওয়ার কারণ তাদের দিকে নজরদারি করার কেউ নেই। বছরের শুরুতেই নানা সুযোগ-সুবিধার কথা বলে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে দেখা যায় এসব প্রতিষ্ঠানকে। এসব কিন্ডার গার্টেনগুলোর মধ্যেই চলে রীতিমতো প্রতিযোগিতা।

কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো প্রতিষ্ঠান বেশি সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে। আর অভিভাবকরা তো আজকাল কেবল ফল পেতে আগ্রহী। যে প্রতিষ্ঠানে ভালো ফল হয় সেখানে নিজের প্রিয় সন্তানকে ভর্তি করাতে উঠে পড়ে লেগে যায়। রীতিমতো ডোনেশন দিয়ে হলেও ভর্তি করাতে ব্যস্ত হয়ে যায়। যেখানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ করে মফস্বল এলাকার অনেক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর আসন অনেক ফাঁকা থাকে। তাহলে সমস্যা কোথায়? কেন এত সুযোগ-সুবিধা দেয়া সত্তে¡ও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন করতে পারছে না। কারণ ফলাফলে কিন্ডার গার্টেনগুলোই এগিয়ে থাকে।

সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ডিজিটাল করার লক্ষ্যে যেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ল্যাপটপ, প্রজেক্টর পৌঁছে দিচ্ছে। তা ছাড়া সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল চালুর পরিকল্পনা করছে এবং ইতোমধ্যেই অনেক এলাকায় তা বাস্তবায়িত হয়েছে। আর শিক্ষকের কথা বললে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এখন যারা নিয়োগ পাচ্ছে তারা দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষিত। বিনা বেতনে লেখাপড়া করার সুযোগ ছাড়াও বৃত্তিও দেয়া হয়। এ ছাড়াও প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণসহ আরো সুযোগ-সুবিধা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে। অপরদিকে কিন্ডার গার্টেনগুলোতে লেখাপড়া করা শিশুদের মাসে মোটা টাকা বেতন দিতে হয়, অতিরিক্ত বই কিনতে হয়। কিন্তু তারপরও কিন্ডার গার্টেনের প্রতি যে আস্থা জন্মেছে তা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে হচ্ছে না কেন। হলেও তা এত ধীরগতিতে কেন? প্রথমেই একটা প্রশ্ন আসে তা হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যারা চাকরি করেন তাদের সন্তানরা সবাই কি সরকারি স্কুলে লেখাপড়া করে? এমনটা দেখা যায় যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সন্তানরা প্রায়ই এলাকার নামিদামি কোনো কিন্ডার গার্টেনে লেখাপড়া করে। সবাই না তবে এই হারটাই বেশি হবে। তাহলে নিজের সন্তানকে যদি নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা অন্য কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে দিতে আস্থা না থাকে তাহলে অন্য অভিভাবকদের দোষ দিয়ে লাভ কি? এটা একটা কারণ মাত্র কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যের আস্থা অর্জন করতে হলে প্রথমে নিজেকেই করে দেখাতে হবে। সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে হলে এটা করতে হবে। আমি কিন্ডার গার্টেনের ওপর ভরসা করলে অন্যরা তা করবেই। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি অনেকটা দীর্ঘ বলে মনে হয়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি। অপরদিকে দেশের কিন্ডার গার্টেনের সময়সূচি সকালে। দুপুর ১২টার আগেই এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা বাড়ি ফেরে। এসব ছাত্রছাত্রীরা যখন খেলাধুলা করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা স্কুল শুরু করে। কিন্তু সমস্যা এখানে না। সময়টা নিয়ে দেশের শিক্ষাবিদরা একটু গবেষণা করতে পারে। একটু কমানো বা সময়সূচিকে নতুন করে করা যেতে পারে। আর একটা বিষয় হচ্ছে একজন সহকারী শিক্ষক হিসেবে যখন কেউ যোগদান করেন তখন তাদের ভেতর পদোন্নতি পেয়ে প্রধান শিক্ষক বা সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে বা তার থেকেও বড় পদে চাকরির আশা করতে পারে। কারণ অন্য সরকারি চাকরিতে পদোন্নতির সুযোগ যতটা রয়েছে এখানে ততটা নেই। সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষকে উন্নীত হলেও সেই প্রক্রিয়াও খুব দীর্ঘ। দেশের দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলগুলোতে স্কুল ফিডিং কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিস্কুট দেয়া হয়। এখন সরকার মিড ডে মিল দেয়ার চিন্তাভাবনা করছে। দেশের অনেক স্থানেই মিড ডে মিল চালু হয়েছে। এই বিস্কুট দেয়া বা মিড ডে মিল চালু করা এসবের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি করা। এই হার একশ ভাগে উন্নীত করা। মিড ডে মিল বিস্কুট দেয়ার থেকে অনেক বেশি কার্যকর হবে এ কথা নিশ্চিত। তবে এই ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চালু করা অনেক বড় একটি বিষয়। সেই দিনটা সত্যি অনেক আনন্দের হবে যেদিন দেশের প্রতিটি বিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্রছাত্রী মিড ডে মিলের সুযোগ পাচ্ছে। সেটা নিশ্চয়ই বিনামূল্যে বই বিতরণের মতোই আরো বড় একটি ব্যাপার হবে। বর্তমান সরকারের সময়কালেই এই বিরাট আনন্দের বিষয়টি বাস্তবায়িত হবে বলে আমার বিশ্বাস। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দক্ষ আরো একটি কারণে যে, এসব শিক্ষককে নিয়মিতভাবে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এই প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য শিক্ষকদের শিশুদের শিক্ষাদানের পদ্ধতির উন্নয়ন করা। তাহলে এত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক যে স্কুলগুলোতে শিক্ষা দেয় সে সব স্কুলের ওপর এখনো মানুষের শতভাগ আস্থা হবে না কেন? কিন্তু এসব পাওয়া প্রশিক্ষণের কতটা সে শ্রেণিতে প্রয়োগ করে সেটার ওপর নির্ভর করে প্রশিক্ষণের সাফল্য। কেন কিন্ডার গার্টেনে ভর্তির জন্য অভিভাবকরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। এটা আজকালকার অনেক অভিভাবকের একটা ফ্যাশন হয়েও দাঁড়িয়েছে। যে যত ভালো কিন্ডার গার্টেনে সন্তানকে ভর্তি করতে পারবে সে তত সন্তানকে নিয়ে প্রতিবেশীদের কাছে গর্ব করতে পারে।

বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের পদক্ষেপে বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো জাতীয়করণ করা হয়েছে। আর পে-স্কেল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের বেতনও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই শিক্ষকদের আন্তরিকতাও আরো একটু বৃদ্ধি করতে হবে। মূলত সবকিছু থাকা সত্ত্বেও আন্তরিকতার ঘাটতি আজো রয়েই গেছে। আগে যে শিক্ষকদের শিক্ষকতার পাশাপাশি অন্য কাজ করতে হয়েছে সংসার চালানোর চিন্তায়, এখন তো আর তা করতে হচ্ছে না। অন্তত আগের সেই চাপ আর নেই। তাই শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে একটু মনোযোগী হওয়া যায়।

আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে শিক্ষক সংকট। বিভিন্ন সময় পত্রিকার পাতায় এই শিক্ষক সংকটের খবর দেখতে পাই। সহকারী শিক্ষকের পাশাপাশি রয়েছে প্রধান শিক্ষকের সংকট। নানা জটিলতায় এই সংকট পূরণ করা যাচ্ছে না। পুল ও প্যানেল থেকে অনেক শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে শিক্ষকের সংকট কিছুটা কাটলেও তা রয়েই গেছে। তা ছাড়া যে বিদ্যালয়েগুলোতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু করা হয়েছে সে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক সংকট চরমে। অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীতকরণ প্রক্রিয়াটিও থমকে রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষাস্তর সব শিক্ষাস্তরের ভিত্তি। সরকার এই স্তরকে শক্তিশালী করতে সব রকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ওপর আস্থা এবং কিন্ডার গার্টেন নির্ভর শিক্ষার প্রভাব কমাতে শিক্ষকদেরই এগিয়ে আসতে হবে। তাদের আন্তরিক হতে হবে এবং নিজেদের প্রমাণ করতে হবে। সমস্যা থাকবে কিন্তু সমস্যা এই স্তরকে থামাতে পারবে না।

অলোক আচার্য্য : সাংবাদিক ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App