×

মুক্তচিন্তা

ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় সরকার?

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০১৮, ০৮:০৩ পিএম

এই ‘জাতীয় সরকার’ বিষয়টি হঠাৎ কোথা থেকে নাজেল হলো? ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে যে অমন একটি সরকার হবে, সেটা কীভাবে? নির্বাচনে না জিতে তারা কীভাবে জাতীয় সরকার কায়েম করবেন?

চলতি হাওয়া

‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না’- জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের এই লাইনটি আমার মনে পড়ে গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেনের বক্তৃতা-বিবৃতি পড়ে। ড. কামাল খবর হন মাঝে মাঝে, সব সময় নয়। তার বক্তৃতা-বিবৃতি যে সব সময় সব গণমাধ্যমে প্রচার-প্রকাশ হয়, তা-ও নয়। তবে দেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কামাল হোসেন নামটা ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসলেও দুচারটি গণমাধ্যম তাকে মনে রেখেছে। সে জন্য মাঝেমাঝে কামাল হোসেনের ‘খবর’ আমার চোখে পড়ে। রাজনীতিটা একটি সার্বক্ষণিক কাজ হলেও আমাদের দেশে অনেক রাজনীতিবিদের কাছেই এখন আর রাজনীতিটা সর্বক্ষণের বিষয় নেই। ড. কামাল হোসেন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী। দেশের রাজনীতিতেও তিনি ছিলেন এক পরিচিত মুখ। গত শতকের নব্বই দশকে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে এবং গণফোরাম নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম দিয়ে যথেষ্ট আলোচনায় এসেছিলেন তিনি। কোনো কোনো অতি উৎসাহী রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ধরে নিয়েছিলেন যে দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে একটি তৃতীয় শক্তির উত্থান বুঝি ঘটে গেল। সৎ ও যোগ্য মানুষদের রাজনীতি গণফোরামের মাধ্যমে দেশে ক্রমেই বলবান হবে বলে কেউ কেউ খুশি হয়েছিলেন। এমন একটি ধারণা কারো মধ্যে তৈরি হয়েছিল যে, খুব দ্রুতই গণফোরাম দেশের নতুন শাসক দলে পরিণত হতে যাচ্ছে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক, প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক গিয়ে ভিড়লেন কামাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক হলেন। ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। গণফোরামের সঙ্গে যারা যুক্ত হলেন তাদের চোখেমুখে তখন অন্যরকম এক দীপ্তি। তারা রাজনীতিতে অচিরেই আওয়ামী লীগের জায়গা দখল করবে- এমন একটা ভাব। একদিন কথা প্রসঙ্গে মানিক ভাইও আমাকে বললেন, আর বি-টিম, সি-টিমের প্লেয়ার নয়, এবার খেলবেন এ-টিমের হয়েই। ছোট দলের বড় নেতা নয়, বড় দলের বড় নেতাই হতে চান।

মানিক ভাইয়ের কথা শুনে সে দিন আমি খুশি হতে পারিনি। বরং তার মতো পোড় খাওয়া একজন নেতা কীভাবে কামাল চক্করে পড়লেন সেটা ভেবে একটু বিচলিত বোধ করলাম। কামাল হোসেন বড় আইনজীবী এবং অত্যন্ত মেধাবী একজন মানুষ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজনীতিটা শুধু মেধা দিয়ে সব সময় হয় না। এর জন্য দরকার হয় সাধারণ কিছু কাণ্ডজ্ঞান এবং সাধারণ মানুষের মনমানসিকতা বোঝার ক্ষমতা। আমার বরাবরই মনে হয়েছে, ড. কামাল হোসেন আমাদের দেশের রাজনীতির জন্য খুব উপযুক্ত ব্যক্তি নন। তার মেধা আছে কিন্তু মানুষকে বোঝার ক্ষমতা তার কম। কামাল হোসেনকে রাজনীতিতে জায়গা করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কামাল হোসেন রাজনীতিতে যে আলো ছড়িয়েছেন তা চাঁদের আলো, সূর্যের কাছে ধার করা অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের মিলিত আলোয় আলোকিত ছিলেন ড. কামাল। তিনি যতক্ষণ আওয়ামী লীগে ততক্ষণ তিনি ‘কেউকেটা’, আওয়ামী লীগ ছাড়লে তিনি কেউ নন।

কামাল হোসেন যে রাজনীতিতে সুবিধা করতে পারবেন না সে ব্যাপারে আমি কেন যেন মোটামুটি নিঃসংশয় ছিলাম। কামাল হোসেন সম্পর্কে আমার দুটো বড় জিজ্ঞাসা ছিল। যা এখনো আমার কাছে প্রশ্ন হয়েই আছে। প্রথমটা হলো মুক্তিযুদ্ধে তার ভ‚মিকা আর দ্বিতীয়টি হলো পঁচাত্তর-পরবর্তী ভ‚মিকা। কামাল হোসেন মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস কোথায় ছিলেন? পাকিস্তানের কারাগারে? তিনি কবে এবং কীভাবে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন? যুদ্ধ শেষে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেশে ফিরলেন। বঙ্গবন্ধু কি তার নয় মাসের অবস্থান জানতেন? তার সম্পর্কে কোনো তথ্য কি আওয়ামী লীগ বা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সরকারের কাছে ছিল? একাত্তরের ‘অস্পষ্ট’ ভূমিকা কামাল হোসেনের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক জীবনের জন্য একটি কালো দাগ হয়ে আছে বলে আমার মনে হয়।

কামাল হোসেনকে বঙ্গবন্ধু স্নেহ করতেন, তার মেধার উচ্চ মূল্যায়ন করতেন বলেই তাকে স্বাধীন দেশের প্রথম সংবিধান রচনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর ড. কামাল কি তার যোগ্য ভ‚মিকা পালন করেছিলেন? আমার ব্যক্তিগত বুঝ হলো, রাজনীতি করার জন্য যে আলাদা একটা সাহস এবং আত্মবিশ্বাস দরকার হয়, সেটার ঘাটতি রয়েছে কামাল হোসেনের। তার দোলাচল চিত্তবৃত্তি তাকে রাজনীতির জন্য আনফিট করে দিয়েছে। তার কারণেই গণফোরাম আজ মরুপথে হারিয়েছে দিশা।

কামাল হোসেনকে মাঝে মাঝে রাজনীতিতে সক্রিয় দেখা যায়। দেশের মানুষ জরুরি প্রয়োজনে তাকে কাছে পায় না। তার সম্পর্কে জনপ্রিয় কৌতুক হলো, তিনি দেশে থাকেন কম সময়, দেশের বাইরে থাকেন বেশি সময়। ফলে রাজনীতিতে সুবচন দান করা ছাড়া তার আর কিছু করার নেই।

গত ২৭ মার্চ গণফোরামের উদ্যোগে একটি আলোচনা সভা হয়েছে রাজধানীতে। ওই আলোচনা সভায় ড. কামাল হোসেন তার বক্তৃতায় বলেছেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের যে সংবিধান দিয়ে গেছেন সে সংবিধানের মূল কথা দেশের মালিক জনগণ। জনগণের একজন হিসেবে আমি দেশের মালিক, আমার অধিকার আছে ভোট দিয়ে আমার প্রতিনিধি নির্বাচন করার। সে অধিকার থেকে আজ জনগণকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

‘দেশের মালিক জনগণ’- এ কথা ড. কামাল হোসেন তার প্রায় সব বক্তৃতায় উল্লেখ করে থাকেন। প্রশ্ন হলো, কোন জনগণ দেশের মালিক? ড. কামাল হোসেন এবং আমার সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থান কি এক রকম? কেবল ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করলেই কি গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে পারে। ভোটের অধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত করছে কে বা কারা? যারা নানা বাহানা তুলে নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকছে, নির্বাচন ভণ্ডল করার জন্য আগুন সন্ত্রাসের পথ ধরেছে তাদের বিরুদ্ধে ড. কামাল হোসেন মুখ খুলেছিলেন কি? এক সময় সরব, আরেক সময় নীরব এই নীতিতে চলে জনগণের প্রকৃত অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে কি?

কামাল হোসেন তার বক্তৃতায় আরো বলছেন, ‘আর ঘরে বসে থাকার সময় নেই। মানুষের কাছে যেতে হবে, মানুষের সমস্যার কথা বলতে হবে, রাজপথে নামতে হবে। বঙ্গবন্ধু বলতেন, বড় অর্জনের জন্য প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ জাতি। এখন ঐক্যের ডাক পৌঁছে দিতে হবে’। এই যে এতগুলো ‘হবে’ সেটা কে করবে? তিনি নিজে মানুষের কাছে কতটুকু যাচ্ছেন? বিদেশের টিকিট পকেটে রেখে ঐক্যের ডাক দিলে যে, জাতি ঐক্যবদ্ধ হবে না- এটা না বোঝার মতো মানুষ কামাল হোসেন নন।

কামাল হোসেনের সভায় চমকপ্রদ মন্তব্য করেছেন দুজন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র খ্যাত এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, ‘আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় এলেও বিশৃঙ্খলা হবে, নৈরাজ্য হবে। খালেদা জিয়াও তা ঠেকাতে পারবেন না। তাই এখন দেশে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় সরকারের প্রয়োজন। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগকে মারে আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বিএনপিকে মারে। এটা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ আওয়ামী লীগ বিএনপিকে বাদ দিয়ে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় সরকার কায়েম করা।

এই ‘জাতীয় সরকার’ বিষয়টি হঠাৎ কোথা থেকে নাজেল হলো? ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে যে অমন একটি সরকার হবে, সেটা কীভাবে? নির্বাচনে না জিতে তারা কীভাবে জাতীয় সরকার কায়েম করবেন? ভোটের অধিকার বঞ্চিত থাকার জন্য যে সভায় খেদ প্রকাশ করলেন ড. কামাল সেই সভায় তার উপস্থিতিতেই তারই নেতৃত্বে বিনা ভোটে জাতীয় সরকার গঠনের কথা বললেন তার দুই গুণমুগ্ধ।

বিষয়টি একটু গোলমেলে মনে হচ্ছে না কি? নির্বাচনের বছরে নির্বাচনবিরোধী কোনো গোপন তৎপরতার অংশ নয় তো এটা? গণতন্ত্রের জন্য কুম্ভীরাশ্রæ বর্ষণকারীদের এ নিয়ে মুখ খুলতে না দেখে কিছুটা হতাশা বোধ করছি।

বিভুরঞ্জন সরকার : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App