×

মুক্তচিন্তা

পরিবর্তনে ‘উন্নয়নশীল দেশ’ তবু অভ্যাস বদলাতে হবে

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ এপ্রিল ২০১৮, ০৭:৩৮ পিএম

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে ‘উন্নয়ন’ কিংবা ‘উন্নত’ রাষ্ট্রের স্বপ্ন আমাদের ভোগের বস্তুতে পরিণত হবে না। তাই আমাদের দেহ এবং মন থেকে সব ধরনের নেতিবাচক অভ্যাস ঝেড়ে ফেলতে হবে। তবেই আমাদের উন্নয়ন সহজ হবে- উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্নও বাস্তবে রূপলাভ করবে ২০৪১ সালে মধ্যে।

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল বাংলাদেশ সরকারকে ‘অফিসিয়ালি’ অবগত করেছে যে, বাংলাদেশ যেহেতু স্বল্পোন্নত দেশ থেকে ‘উন্নয়নশীল’ দেশে উন্নীত হওয়ার তিনটি পূর্বশর্ত পূরণ করেছে তাই ২০১৮ সাল থেকে পরিপূর্ণভাবে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার কার্যক্রমপর্ব শুরু হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক এই সাফল্য নিয়ে সরকার এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মধ্যে উৎসাহ, উদ্দীপনা এবং উত্তেজনারও শেষ নেই। এটাই স্বাভাবিক। এই উৎসাহ, উদ্দীপনা আর উত্তেজনাই সামনের আরো বড় বড় অর্জনের দিকে নিয়ে যাবে বাংলাদেশকে। বলে রাখা ভালো যে, আমরা কেবল উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক পর্যায়ে অবস্থান করছি। আগামী ছয় বছর পর্যবেক্ষণ করার পর সবকিছু ‘ঠিকঠাক’ থাকলে ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষণা করবে। সুতরাং আগামী বছর আমাদের জন্য নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আগামী ছয় বছরের মধ্যে পরিপূর্ণরূপে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার অন্যান্য শর্তগুলো বাংলাদেশকে কেবল অর্জনই করতে হবে না ইতোপূর্বেকার অর্জিত সাফল্যের বিষয়গুলোতে পাকাপোক্ত অবস্থান আরো দৃঢ়তর করবে। সক্ষমতা ও সাফল্যের সব সূচক ঊর্ধ্বমুখী রাখার জন্য আগামী ছয় বছর তাই পরিকল্পিতভাবে অগ্রযাত্রার ছক প্রণয়ন করতে হবে বাংলাদেশকে। এ বিষয়ে সরকারকে দক্ষতার সঙ্গে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে মনোযোগী হতে হবে। মনোযোগ দিতে হবে স্বচ্ছতার প্রতি, মনোযোগ দিতে হবে দক্ষতার প্রতিও।

আবার এই ‘মনোযোগ’-এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনাচরণের কিছু অভ্যাস, ধারণা, আচরণ, কথোপকথন, দেহভঙ্গি অর্থাৎ এককথায় নেতিবাচক সর্বপ্রকার জেশ্চার বদলাতে হবে- বদলিয়ে ফেলতে হবে। সামষ্টিক ভাবনার পাশাপাশি ব্যষ্টিকভাবেও প্রত্যেককে তার মানসিক চিন্তার জগৎ এবং একই সঙ্গে দৈহিক ভঙ্গিমার মধ্যেও প্রকাশমান নেতিবাচক সর্বপ্রকার জেশ্চার বদলিয়ে ফেলার এই প্রেরণাকে সক্রিয় করে তুলতে হবে। রাষ্ট্রের উন্নয়নশীলতাকে মাথায় রেখে হলেও নিজেকে দরিদ্র ভাববার প্রবণতা, নিজেকে হীন ভাববার প্রবণতা ত্যাগ করতে হবে সবার আগে। ‘অন্যের অর্থ’ ছাড়াও জীবনযাপন সম্ভব এই ভাবনা নিজের মনের ভেতর প্রোথিত করতে হবে- অর্জন করতে হবে ব্যক্তিক মর্যাদাবোধও। এটি সম্ভব হলেই ‘হাত পাতার’ অভ্যাস তথা পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকবার অভ্যাসটিও বদলে যাবে।

হাত পাতার নানামুখী প্রবণতা আমাদের জীবনের সর্বত্র। ছোটরা হাত পাতে বড়র কাছে, বড়রা হাত পাতে ছোটর কাছে। হাত পাতার এই অভ্যাস বা প্রবণতা ছোটখাটো চাকরিজীবী থেকে শুরু করে বড় বড় আমলা এমনকি রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সক্রিয় আছে বলে প্রায়শই শোনা যায়। ‘কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়’ সংস্কৃতিতে আচ্ছন্ন আমাদের প্রশাসনিক সব স্তর। পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনও এর বাইরে নয়- যা আরো বেশি বিপজ্জনক বিষয়। মানুষের মধ্যে ব্যক্তিক মর্যাদাবোধ জাগ্রত হলে, হাত পাতার এই জেশ্চার কিংবা পরমুখাপেক্ষিতার অদৃশ্য ভঙ্গিও দূর হয়ে যাবে। মানুষের মধ্যে মর্যাদাবোধ জাগ্রত হলে ছোটরা বড়র কাছে কিংবা বড়রা ছোটর কাছে হাত পেতে ঘুষ নেবে না- কোনো কাজের অসিলায় অন্যের উপার্জনে ভাগ বসাবে না। অন্তত এরূপ বোধ জাগ্রত হলে সে বুঝতে পারবে অন্যের টাকার ওপর তার কোনো অধিকার নেই, নেই অংশভাগও। অন্যের টাকায় আমি খাব না, পরব না, এমনকি কোনো ধরনের সম্পদও গড়ে তুলব না। নীতি ও নৈতিকতার এই শিক্ষা অথবা বোধ যাকে আমরা মর্যাদাবোধ বলি তা স্কুল পর্যায় থেকেই শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। বড় হয়ে তারা যেন কর্মক্ষেত্রের নিজ নিজ ‘দায়িত্ব ও কর্তব্যে’র মধ্যে থাকা কাজ করে দেয়ার নাম করে অন্যায়ভাবে অন্যের কাছে বেতন বহিভর্‚ত অর্থের জন্য চাপ প্রয়োগ না করে। স্বাধীনতার সাতচল্লিশ বছর পর এখন পর্যন্ত মানুষকে একটি কাজ করে দেয়ার নাম করে সমাজ ও রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী প্রত্যেকেই সুযোগ মতো যে যার কাছে পারে যত খুশি টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে! অথচ সে মনেই রাখছে না যে, ওই কাজ করবার জন্যই রাষ্ট্র তাকে মাসোয়ারা দিয়ে পুষছে দিনের পর দিন। আবার পেনশন দিয়ে অবসর জীবনেও রাষ্ট্র ওই লোক ও তার পরিবারটিকেও পুষবে!

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন দ্বিগুণ হওয়ার পর আশা করা গিয়েছিল যে, তাদের মধ্য থেকে দুর্নীতির এই প্রবণতা দূর হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই প্রবণতা বরং প্রতিযোগিতামূলকভাবেই সুবিধাভোগী গোষ্ঠীটির মধ্যে টিকে আছে। এ যেন তাদের ‘অধিকার’। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেও দেখা যায় এলাকার কোনো সমস্যা সমাধানের নাম করে সৃষ্ট সমস্যার মধ্যেই বরং আরো নানারূপ জটিলতর প্যাঁচ-গোচ লাগিয়ে দুর্ভোগ-জর্জরিত ব্যক্তির কাছে থেকে বিভিন্ন ফন্দি-ফিকিরে টাকা খাওয়ার ব্রিটিশ আমলি কৌশল। এই প্রবণতার প্রভাবে কখনো কখনো কোথাও কোথাও সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার খবরও আমাদের শঙ্কিত করে তোলে। অনৈতিকভাবে টাকা-পয়সার বিনিময়ের মাধ্যমে ‘কাজ’ হওয়ার এই অপসংস্কৃতির জন্যই দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বলি বা রাষ্ট্র বলি তা গঠন সম্ভব নয়। বরং দুর্নীতিই নানাভাবে প্রাতিষ্ঠানিক অবয়বে আমাদের চারপাশে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে অস্তিত্ব জাহির করে চলেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই দুর্নীতির জন্যই উন্নয়নের পথে অগ্রসরমান বাংলাদেশ এখনো বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ঝুলে আছে। জননেত্রীর কাক্সিক্ষত ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়বার প্রত্যাশাও দুর্নীতির ঝুঁকিমুক্ত নয়। সুতরাং সরকারকে এ ক্ষেত্রেও কৌশলী হতে হবে।

আমরা সাড়ম্বরে স্বাধীনতার সাতচল্লিশ বছর পেরিয়ে আটচল্লিশ বছরে পা রাখলাম। বিগত সাতচল্লিশ বছরের মধ্যে একুশ বছর কেটেছে নানা রকমের স্বৈর ও ছদ্ম-স্বৈরশাসনের কবলে। স্বল্পোন্নত দেশে সামরিক শাসন দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় দেশের সার্বিক উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নিরবচ্ছিন্ন হয় না। বাংলাদেশকেও এ রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অনেক সময় পার করতে হয়েছে। ফলে এ দেশের মানুষও যথার্থ উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা ও দিকনির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। বিদেশি সাহায্য নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের মতো করে স্বপ্ন দেখবার ও স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে অংশ নেয়ার স্পর্ধা অর্জন করতে পারেনি এ দেশের মানুষ। অর্থনীতিবিদরা তাই মনে করেন ‘সত্তর ও আশির দশকের ওই দুর্দশা ও বিশ্ব ভিক্ষুকের দীনহীন অবস্থা থেকে গত সাড়ে তিন দশকে বাংলাদেশের যে চমকপ্রদ অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা, তাতে প্রধান ভূমিকা পালন করে চলেছে কৃষি খাত, রপ্তানি খাত, প্রবাসীদের রেমিটেন্স, ক্ষুদ্র ঋণ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাত।’

আমরা জানি যে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ ছিল অত্যন্ত দরিদ্র, কিন্তু আয় বণ্টনের বৈষম্য ছিল সীমিত। তার তুলনায় আজকের বাংলাদেশ হতদরিদ্র দশা কাটিয়ে উঠেছে, বিশেষভাবে গত বেশ কয়েক বছরে সামরিক শাসনের অবসান-পরবর্তী ‘গণতন্ত্রায়নের’ যুগে জাতীয় আয়ের দ্রুত প্রবৃদ্ধি ঘটেছে এবং একই সঙ্গে বণ্টন বৈষম্যও দ্রুত বেড়ে গেছে। অপরদিকে অর্থনীতিবিদদের মতে, ‘আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও রয়েছে। টাকার মূল্য স্থিতিশীল হয়েছে এবং রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়েছে বিপুল পরিমাণে, এ কারণে জনগণের ব্যয়ের সক্ষমতা বেড়েছে। বাংলাদেশ আর বিদেশি সহায়তানির্ভর অর্থনীতির দেশ নেই। বিদেশি সহায়তা এখন জিডিপির ২ শতাংশের কম। এই ইতিবাচক সামষ্টিক অর্থনৈতিক ধারা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর উন্নয়ন ও দারিদ্র্যদূরীকরণের মতো মানব উন্নয়ন সূচকগুলোর সঙ্গে খাপ খেয়েছে।’

বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পশ্চাতে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা বিশেষত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখেছে। দেশের উন্নয়নে সর্বসাধারণকে অংশগ্রহণে বর্তমান সরকারের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনামলেই আমরা দেখি ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। কৃষির প্রায় সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক অর্জন বর্তমান সরকারের শাসনামলেই সম্ভব হয়েছে। শাক-সবজি উৎপাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। আর মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে চতুর্থ হতে সক্ষম হয়েছে। দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে কর্মস্পৃহা আছে আর তাকে এক স্বাপ্নিক দ্যোতনায় ঝংকৃত করেছেন বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। বিটিআরসির তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৪ কোটি ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে আবার ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৮ কোটি। উন্নত একটি রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পথে এসব অর্জনকে অবশ্যই ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। তবে এখনো আশঙ্কার বিষয় ওপরে বর্ণিত রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি। দুর্নীতিকে হটিয়ে দিতে না পারলে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। শিক্ষার হার বেড়েছে, এখন শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করাও বিরাট চ্যালেঞ্জ। সেই সঙ্গে দক্ষতাসম্পন্ন জনশক্তি সৃষ্টিও কম বড় চ্যালেঞ্জ নয়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে ‘উন্নয়ন’ কিংবা ‘উন্নত’ রাষ্ট্রের স্বপ্ন আমাদের ভোগের বস্তুতে পরিণত হবে না। তাই আমাদের দেহ এবং মন থেকে সব ধরনের নেতিবাচক অভ্যাস ঝেড়ে ফেলতে হবে। তবেই আমাদের উন্নয়ন সহজ হবে- উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্নও বাস্তবে রূপলাভ করবে ২০৪১ সালে মধ্যে। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রবর্তন আর আমাদের নেতিবাচক প্রবণতাগুলো পরিত্যাগ করতে পারলে ২০৪১ সালের আগেই আমরা উন্নত রাষ্ট্রের নাগরিকে পরিণত হতে পারি।

ড. আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App