×

মুক্তচিন্তা

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভবিষ্যৎ

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০১৮, ০৯:৪৩ পিএম

বাংলাদেশকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলার এবং বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ভাষা রূপে প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে বিরাজিত অন্তরায়গুলো একে একে দূর করতে হবে। তার জন্য সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা দরকার। যারা দ্বৈত নাগরিক, যাদের স্ত্রী অথবা স্বামী অথবা সন্তান দ্বৈত নাগরিক কিংবা বিদেশি নাগরিক, তারা যাতে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি, উপমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী, উপসচিব থেকে সচিব, জজকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইত্যাদি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হতে না পারেন, সংবিধানে তার সুস্পষ্ট বিধান রাখতে হবে।

নবযুগের প্রত্যাশায়

দেশ এবং রাষ্ট্র এক নয়। দেশ প্রকৃতির সৃষ্টি আর রাষ্ট্র মানুষের। পাহাড়, পর্বত, সমুদ্র, মরুভ‚মি ইত্যাদি প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা দ্বারা পরিবেষ্টিত এক একটি বিশাল ভ‚ভাগ হলো এক একটি দেশ। রাষ্ট্র না থাকলে দেশ থাকে। দেশ স্বাধীন হতে পারে, আবার পরাধীনও হতে পারে। রাষ্ট্র পরাধীন হলে রাষ্ট্র থাকে না, উপনিবেশ হয়ে যায়। উপনিবেশ আর রাষ্ট্র এক নয়। বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে রক্ষা করতে হলে এর সমস্যাবলী নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা দরকার। সময় ও সুযোগ হারিয়ে গেলে হাহাকার করে কোনো লাভ হবে না।

মুজিবকে হত্যার পর কয়েক বছর ভীষণভাবে প্রচার করা হয় যে, ভারত বাংলাদেশকে তার প্রদেশ বানিয়ে নেবে- স্বাধীন রাষ্ট্রসত্তা নিয়ে টিকতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে চলতে হবে। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশ ভারতের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যায়। ১৯৯০-এর দশকে বিএনপির পক্ষ থেকে ক্রমাগত ভীষণভাবে প্রচার করা হয় যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশকে ভারতের কাছে বিক্রি করে দেবে। এ নিয়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকায় এবং আরো কোনো কোনো পত্রিকায় তখন আওয়ামী লীগের বাংলাদেশ বিক্রি নিয়ে চমৎকার সব কার্টুন ছাপা হয়। পরে আওয়ামী লীগ যখন কিছুটা শক্তি অর্জন করে তখন থেকে দলটি বিএনপির ভারত-বিরোধী প্রচারের প্রতিক্রিয়ায় প্রচার করতে থাকে যে, বিএনপি সুযোগ পেলেই বাংলাদেশকে পাকিস্তানের হাতে তুলে দেবে। আওয়ামী লীগ প্রচার চালাতে থাকে যে, বিএনপি বাংলাদেশে বিশ্বাস করে না, সুযোগ পেলেই দলটি জামায়াতের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলবে। দুই দলের মধ্যে শত্রুতার সম্পর্ক চলমান আছে। গত প্রায় সাতচল্লিশ বছরে বাংলাদেশ কি রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছে? আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কি রাষ্ট্র গঠনের জন্য বাংলাদেশের জনগণের ওপর আস্থা রাখে? দল দুটোর মধ্যে কি কোনো প্রকার জাতীয়তাবোধ কিংবা রাষ্ট্রবোধ আছে?

বিএনপি দশ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে আছে। এই সময়ের মধ্যে দলটি গণতন্ত্রের জন্য (ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য) ক্রমাগত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রের স্থানীয় রাষ্ট্রদূতদের কাছে গিয়ে ধরনা দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতার বাইরে ছিল তখন আওয়ামী লীগও একই কাজ করেছে। এই চরিত্রের রাজনৈতিক দল দিয়ে কি কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে উঠতে পারে?

ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা এবং ভূ-রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে ১৯৭০-এর দশকের শেষদিক থেকেই কোনো কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তি বলে আসছেন যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার মতো (viable) নয়। ...তাঁদের যুক্তি ও মত কখনো আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। বাঙালি-চরিত্রের উন্নতি সব সময় আমরা আশা করেছি, এখনো করি। যারা বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার মতো (viable) নয় বলে মনে করেন, তারা অনেকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রে গিয়ে নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। তাদের প্রায় সবাই নিজেদের সন্তানদের ওইসব রাষ্ট্রে নাগরিক করেছেন। আমরা সব সময় মনে করেছি এবং এখনো মনে করি, বাংলাদেশকে অবশ্যই বাংলাদেশের জনগণের প্রগতিশীল রাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলা যাবে। সে লক্ষ্যেই আমাদের চিন্তা ও কাজ।

কিন্তু কিছু ঘটনা আমাদের মর্মাহত করে। সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনগুলোর বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশের রাজনীতিকে বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসমুখী করেছেন। বাংলাদেশের সব প্রচারমাধ্যম ১৯৮০-র ও ১৯৯০-এর দশকে বিবিসি রেডিওর অন্ধ অনুসারী হয়ে কাজ করেছে। ক্ষমতার বাইরে থাকাকালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি নিয়ে ক্রমাগত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার এবং ভারতেরও স্থানীয় দূতাবাসগুলোতে গিয়ে ধরনা দেন। তারা চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্কে। সাম্রাজ্যবাদী অর্থসংস্থাগুলো দাতা-সংস্থা ও উন্নয়ন-সহযোগী হয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারণ করে। শাসকশ্রেণির লোকেরা (সরকারি ও সরকার-বিরোধী সব মহলের) তাদের ছেলেমেয়েদের যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রের নাগরিক করে চলছেন। মন্ত্রিপরিষদ, জাতীয় সংসদ, প্রশাসন-ব্যবস্থার উচ্চপর্যায়, শিক্ষা-ব্যবস্থার উচ্চপর্যায় লক্ষ করলেই এটা দেখা যায়। এই ব্যক্তিরাই বাংলাদেশে রাষ্ট্রব্যবস্থার ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কর্তৃত্বে আছেন। বাংলাদেশে একদিকে আছে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ব্রিটিশ কাউন্সিল ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে পরিচালিত প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে আছে। এসব ব্যাপার বাংলাদেশের ভূভাগে জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

বাংলাদেশকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলার এবং বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ভাষা রূপে প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে বিরাজিত অন্তরায়গুলো একে একে দূর করতে হবে। তার জন্য সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা দরকার। যারা দ্বৈত নাগরিক, যাদের স্ত্রী অথবা স্বামী অথবা সন্তান দ্বৈত নাগরিক কিংবা বিদেশি নাগরিক, তারা যাতে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি, উপমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী, উপসচিব থেকে সচিব, জজকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইত্যাদি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হতে না পারেন, সংবিধানে তার সুস্পষ্ট বিধান রাখতে হবে। বিধান এমন হবে যে, অন্য রাষ্ট্রে গিয়ে নাগরিকত্ব গ্রহণে কারো ওপর কোনো বিধি-নিষেধ থাকবে না; কিন্তু অন্য রাষ্ট্রে নাগরিক হলে (দ্বৈত নাগরিক) কিংবা স্ত্রী বা স্বামী অন্য রাষ্ট্রের নাগরিক বা দ্বৈত নাগরিক হলে কিংবা সন্তান (২১ বছর বয়স পর্যন্ত) অন্য রাষ্ট্রে নাগরিক হলে কেউ বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় উচ্চ পদে থাকতে পারবেন না। যারা তাদের সন্তানদের বিদেশে নাগরিক করার জন্য কিংবা বড় চাকরির জন্য আলাদাভাবে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা নিতে চান, তাদের জন্য ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বাংলাদেশে ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে এ লেভেল, ও লেভেল ইত্যাদি পড়ার সুযোগ অব্যাহত থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র ও আরো কোনো কোনো রাষ্ট্র বাংলাদেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজি মাধ্যমের যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালাচ্ছে সেগুলোও চালবে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের ইংলিশ ভার্সন বিলুপ্ত করতে হবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিবেচনা করতে গেলে দেখা যায়, ইংলিশ ভার্সন বেশি ক্ষতিকর। ‘আদিবাসী’দের চিরকালের জন্য আদিবাসী রূপে রাখার সাম্রাজ্যবাদী নীতি পরিহার্য। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় রেড ইন্ডিয়ানদের এবং অস্ট্রেলিয়ায় আদিবাসীদের যেভাবে রাখা হয়েছে তা অন্যায় এবং তা গোটা পৃথিবীর জন্য গ্রহণীয় নীতি হতে পারে না।

বাংলাদেশে পঁয়তাল্লিশটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর পঁয়তাল্লিশটি বিলীয়মান মাতৃভাষার উন্নতি সাধনের জন্য সরকার ও এনজিওরা যে চেষ্টা চালাচ্ছে, তা সফল হবে না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রসত্তার মধ্যে এসব জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক-সংস্কৃতিক উন্নতির আরো ভালো পরিকল্পনা ও কার্যক্রম দরকার। তাদের সন্তানদের জন্য বাংলা ও ইংরেজি শেখার এবং রাষ্ট্রীয় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ বাড়াতে হবে। তারা যদি চায় কেবল তা হলেই তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে তাদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তারা অন্য নাগরিকদের মতো রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করবে। বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় তারা স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় অনাস্থা ও অবিশ্বাস দূর করে অবস্থাকে স্বাভাবিক করতে হবে।

পশ্চিমা সভ্যতা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই সংকটে আছে। মাঝখানে মার্কসবাদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল মানবজাতির সামনে আশার আলো নিয়ে। কিন্তু মার্কসবাদ এখন আর আবেদনশীল নেই। পৃথিবী এখন চলছে এক আদর্শগত সংকটের মধ্য দিয়ে। এই অবস্থার মধ্যে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীদের প্রতি থেকে আস্থা হারিয়েছে এবং পুরনো সংস্কার বিশ্বাস ও ধর্মের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। এই বাস্তবতাকে বুঝতে হবে। অন্ধভাবে পশ্চিমা কর্তৃত্বকে মেনে নিয়ে এবং বিশ্বব্যাংকের নির্দেশ অনুযায়ী চলতে গিয়ে বাংলাদেশ ভেতর থেকে দুর্বল থেকে দুর্বল হয়ে চলছে। অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সভ্যতা ও প্রগতির পথ অবলম্বন করাও দরকার।

এখানে সংক্ষেপে যে বিষয়গুলোর কথা উল্লেখ করলাম তা থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের সমস্যাগুলো বোঝা যাওয়ার কথা। এসব নিয়ে আরো আলোচনা দরকার। অশুভ বুদ্ধির কর্তৃত্বের জায়গায় শুভ বুদ্ধির কর্তৃক প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে- সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করে চলতে হবে।

আবুল কাসেম ফজলুল হক : চিন্তাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App