×

জাতীয়

শিক্ষা প্রশাসনে হরিলুটের নেপথ্যে ২৯ কর্মকর্তা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১১:১৬ এএম

শিক্ষা প্রশাসনে হরিলুটের নেপথ্যে ২৯ কর্মকর্তা
শিক্ষা প্রশাসনের ২৯ জন কর্মকর্তা সব কিছু থেকে লুটেপুটে খাচ্ছেন। সব কাজেই ভাগ বসিয়ে মধু খান এরা। লুটে নেন লাখ লাখ টাকা। এদের কারণে শিক্ষা প্রশাসনের বদনাম হচ্ছে। কিন্তু অপকর্মকারীদের কোনো শাস্তিই হয়নি। উল্টো বছরের পর বছর ধরে ভালো জায়গায় পদায়ন হয়। এই লুটেরা কর্মকর্তাদের শেকড় এতই গভীরে, খোদ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও তাদের কাছে অসহায়। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বারবারই বলেছেন, অনিয়মকারীদের স্থান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে হবে না। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে উল্টোটা। অনুসন্ধানে এসব কর্মকর্তার কুর্কীতির আমলনামা ঘেঁটে বিস্মিত হওয়ার মতো তথ্য পাওয়া গেছে। এরা পেশায় শিক্ষক হয়ে কিভাবে ভয়ঙ্কর দুর্নীতির মধ্যে জড়ালেন? জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমেদ বলেন, কয়েক দিনের মধ্যেই একটা কিছু দেখতে পাবেন। কোনো দুর্নীতিবাজ এই মন্ত্রণালয়ে থাকতে পারবে না বলেও তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। কিন্তু কবে কি হবে এসব বিষয়ে কিছু জানাননি তিনি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিক্ষা প্রশাসনের কলঙ্কিত এই ২৯ কর্মকর্তা হলেন- ঢাকা বোর্ডের সচিব ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহেদুল খবির চৌধুরী, কলেজ পরিদর্শক ড. আশফাকুস সালেহীন, উপকলেজ পরিদর্শক মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈ (মনি), স্কুল পরিদর্শক এ টি এম মঈনুল হোসেন, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার, উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (সনদ) মাসুদা বেগম, উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. নাজমুল হক, উপপরিচালক মো. ফজলে এলাহী, উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অদ্বৈত কুমার রায়, উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. মাসুদ করিম, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের পরিদর্শক আবুল বাসার, উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মুজিবুর রহমান, পরিদর্শন ও নীরিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) উপপরিচালক মো. রাশেদুজ্জামান, উপপরিচালক রসময় কীর্ত্তনিয়া, পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর আলম, পরিদর্শক গোলাম ফিরোজ, পরিদর্শক সিদ্দিকুর রহমান, পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ আব্দুল মুমিন মোচ্ছাব্বির, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ড. মো. জাহাঙ্গীর, উপপরিচালক (কলেজ-২) মো. মেজবাহ উদ্দিন, এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার (ওএসডি), উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. শফিকুল ইসলাম সিদ্দিকী, উপপরিচালক (শারীরিক শিক্ষা) ফারহানা হক, সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) সাবিনা ইয়াসমিন, সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার শামীম আহসান খান, বিপুল মোরশেদ, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষক মো. সেলিম চৌধুরী, মাউশির টিকিউআই প্রকল্পের সহকারী পরিচালক ড. রেহানা বেগম ও প্রশিক্ষণ শাখার উপপরিচালক খ ম রাশেদুল হাসান। এদের অধিকাংশই নিজেদের অপরাধের কথা স্বীকার করেননি। উল্টো তারা শিক্ষা প্রশাসনের জন্য নিবেদিত প্রাণ বলে দাবি করেছেন। অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, শাহেদুল খবির চৌধুরী ২০০৯ সালে ঢাকা বোর্ডে স্কুল পরিদর্শক পদে যোগদান করে ২০১৮ সালে এসে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। ২০১৭ সালে ঢাকার হোটেল ওয়েস্টিনের সামনে বেসামাল অবস্থায় পুলিশের গুলিতে আহত হন। অথচ অবিবাহিত এই কর্মকর্তা ছাত্রজীবনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের রাজনীতি করতেন। ঢাকা বোর্ডের বর্তমান কলেজ পরিদর্শক ড. আশফাকুস সালেহীন ছাত্রজীবনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের রাজনীতি করতেন। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষামন্ত্রীর সাবেক এপিএস মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈ মনিকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে ঝিনাইদহের একটি কলেজ থেকে মাউশির প্রশিক্ষণ শাখায় উপপরিচালক পদে বদলি হয়ে আসেন। পুরো লেনদেনের মধ্যস্থতা করেন মাউশির সাবেক সহকারী পরিচপালক অদ্বৈত কুমার রায়। সালেহীন এবং অদ্বৈতের বাড়ি একই এলাকায় এবং এরা ব্যক্তিগত সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা। প্রশিক্ষণ শাখার উপপরিচালক থাকাকালীন একটি প্রকল্পের মাধ্যমে টিটি কলেজে কর্মরত ৯২ জন কর্মকর্তাকে অবৈধভাবে শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত করতে ১০ লাখ টাকার কিছু বেশি ঘুষ নিয়েছিলেন তিনি। এর ফলে বিশাল একটি জটিলতা তৈরি হয়। বিষয়টি শিক্ষা ক্যাডারের মামলায় জড়িয়ে পড়ে, যা এখনো চলমান। পরে তিনি ঢাকা বোর্ডে বদলি হয়ে যান। এ ছাড়া একাদশ শ্রেণিতে অনলাইনে ভর্তির জন্য মেধা তালিকা তৈরি করার সময় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈ মনি হচ্ছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সাবেক এপিএস এবং মেয়ের গৃহশিক্ষক। বর্তমানে তিনি ঢাকা বোর্ডের উপকলেজ পরিদর্শক পদে কর্মরত। এই মনিই শিক্ষা প্রশাসন সিন্ডিকেটপ্রধান। শিক্ষা ভবন, এনসিটিবি, বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডসহ শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির মূল হোতা হচ্ছেন মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈ ও তার ঘনিষ্ট কর্মকর্তারা। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষা ক্যাডারের বুনিয়াদি প্রতিষ্ঠান নায়েমের ডিরেক্টর নিয়োগ নিয়ে ক্যাডার সদস্যদের মধ্যে নিয়োগ বিধির দ্ব›দ্ব এই মন্মথ বাড়ৈ মনিই শুরু করেছিলেন। এই দ্ব›েদ্বর ফলে নায়েমে ডিরেক্টর নিয়োগের একটি নথি আটকে যায়। পরবর্তী সময়ে ১০ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা মো. আতিকুল ইসলাম পাঠানকে নিয়োগে কলকাঠি নাড়েন মনি। ঢাকা বোর্ডের উপপরিচালক মো. ফজলে এলাহী গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমল থেকে অর্থাৎ প্রায় ১৬ বছর ধরে ঢাকা বোর্ডে কর্মরত। তার বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। অদ্বৈত কুমার রায় মাউশি থেকে লুটেপুটে খেয়ে ঢাকা বোর্ডে কলেজ শাখার উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদে যোগ দেন। সেখানে ড. আশফাকুস সালেহীনকে পেয়ে অদ্বৈত খুশিতে আত্মহারা হন। অদ্বৈত আশফাকুস সালেহীনকে চাচা সম্বোধন করেন। সেই থেকে ঢাকা বোর্ড চাচা-ভাতিজার দপ্তর নামে পরিচিত। আর কুকর্মও চাচা-ভাতিজা মিলে করেন। মাদ্রাসা বোর্ডের পরিদর্শক আবুল বাসার ২০০৯ সালে মাউশির কলেজ শাখায় সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। সে সময় তৎকালীন শিক্ষা সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর এলাকার এক আত্মীয়ের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ঘুষ নিয়ে তাকে বদলি করায় ক্ষিপ্ত হয়ে সাবেক শিক্ষা সচিব বাসারকে নোয়াখালী সরকারি মহিলা কলেজে বদলি করেন। কিন্তু এপিএস মন্মথ বাড়ৈর পরামর্শে বাসার নোয়াখালী কলেজে যোগদান করা থেকে বিরত থাকেন। সচিব কামাল চৌধুরী বিদেশে গেলে সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিবকে দিয়ে বাসারের নোয়াখালীতে হওয়া বদলির আদেশ বাতিল করে ঢাকা বোর্ডের উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (গোপনীয়) হিসেবে পদায়ন করে দেন। পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও সে সময় বারবার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায় সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে পরিস্থিতি খারাপ হলে বাসারকে মন্মথ মাদ্রাসা বোর্ডে বদলি করিয়ে দেন। বাসারের দুর্নীতির কারণে লাখ লাখ মাদ্রাসা শিক্ষক ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়া বাসারের নৈতিক চরিত্র নিয়েও মুখরোচক আলোচনা রয়েছে। ছাত্রীর সঙ্গে প্রেম করতে গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন এবং পরে স্ত্রীকে পিটিয়ে মেরে ফেলে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এ নিয়ে মামলাও হয়। পরবর্তী সময়ে ওই ছাত্রীকেই তিনি বিয়ে করেন। ডিআইএর উপপরিচালক রাশেদুজ্জমান আপাদমস্তক দুর্নীতিবাজ। টাকা ছাড়া তিনি কিছুই বোঝেন না। ডিআইএর মো. জাহাঙ্গীর, রসময় কীর্ত্তনীয়া, গোলাম ফিরোজ দুর্নীতিবাজ মন্মথ রঞ্জন সিন্ডিকেটের সদস্য। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ আব্দুল মুনিম মোছাব্বির ছাত্রদলের প্রাক্তন নেতা। তিনি পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে বিএনপি-জামায়াত জোটের অনুসারী শিক্ষকদের সংগঠিত করেন। তবে প্রকাশ্যে এই কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের বলে পরিচয় দেন। মাউশির কলেজ শাখার সহকারী পরিচালক মো. মেজবাহ উদ্দিন প্রফেসর পদে পদোন্নতি পেয়েও নি¤œ পদে কাজ করে যাচ্ছেন। ২০১০ সাল থেকে এই পদে কাজ করা মেজবাহ দুর্নীতির দায়ে একবার বদলি হলেও ওই পদে যোগ না দিয়ে বদলির আদেশ বাতিল করেন। এমপিও দুর্নীতিতে তার ব্যাপক নামডাক রয়েছে। মাউশির উপপরিচালক বর্তমানে ওএসডি এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার ছাত্রদলের প্রাক্তন নেতা ও বরিশালের প্রাক্তন মেয়র মজিবর রহমান সরোয়ারের খালাতো ভাই। বিএনপির আমলে শিক্ষাবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব ছিলেন তিনি। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হিসেবে তার ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। বর্তমানে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। সুযোগ পেলেই শিক্ষামন্ত্রী ও সরকারের সমালোচনা করেন। তিনিই জাতীয় পতাকার আদলে কেক বানিয়ে মন্ত্রী নাহিদকে দিয়ে কাটাতে চেয়েছিলেন। গত ২ বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর একটি অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকার ভেতরে পাকিস্তানি পতাকা বিতরণ করেছিলেন। পরে ধরা খেয়ে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন। মাউশির আরেক উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. শফিকুল ইসলাম সিদ্দিকী। দুর্নীতিতে সেরা। দীর্ঘদিন ডিআইএতে পরিদর্শক পদে কর্মরত ছিলেন। দুর্নীতির দায়ে ২০০৯ সালে সদরপুর কলেজে বদলি হন। সে বছর বদলির কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি মাউশির বর্তমান পদে দায়িত্ব পান। তাকে শিক্ষা ভবনের দুর্নীতির মহারাজা বলা হয়। জামায়াত-শিবির অনুসারী এ কর্মকর্তা মাউশির কর্মচারী নিয়োগ, বদলি, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের বদলি, প্রদর্শক থেকে প্রভাষক পদে পদোন্নতির ফিটলিস্ট তৈরি করা, কলেজের বিবিধ বাজেট প্রেরণ করা, গাড়ি মেরামত ও যানবাহনে তেলের ¯িøপে অনিয়ম, মাউশি আসবাবপত্র ও স্টেশনারি কেনাকাটায় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি শিক্ষা ভবনের একটি বিলাসবহুল গাড়ি শিক্ষা মন্ত্রীর দপ্তরের এক কর্মকর্তাকে উপঢৌকন দিয়েছেন। মাউশির উপপরিচালক (শারীরিক শিক্ষা) ফারহানা হক বিএনপির আমলে মোসাদ্দেক আলী ফালুর স্ত্রীর বান্ধবী পরিচয় দিয়ে শিক্ষা প্রশাসনে রাজত্ব করেছেন। এখন শিক্ষামন্ত্রী নাহিদের নাম ভাঙিয়ে রাজত্ব করছেন। মাউশির সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) সাবিনা ইয়াসমিন ২০০৬ সাল থেকে এই পদে কর্মরত। প্রথমে গবেষণা কর্মকর্তা ও পরে একই শাখার সহকারী পরিচালক। তার স্বামী একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক এবং বড় একটি কোচিং সেন্টারের মালিক। বিপুল মোরশেদ ছাত্রদলের প্রাক্তন নেতা। ওই প্রভাব এখনো কাজে লাগিয়ে নানা ফায়দা হাসিল করছেন। টিকিউআইর সহকারী পরিচালক ড. রেহানা বেগম বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলামের শ্যালিকা ও রংপুর জামায়াতের আমিরের ছোট বোন। মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈয়ের সিন্ডিকেটের সদস্য হয়ে তিনি ২০১০ সাল থেকে শিক্ষা ভবনে কাজ করছেন।
 

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App