×

মুক্তচিন্তা

সামাজিক অবক্ষয় ও আত্মহনন প্রবণতা

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০৯:১৭ পিএম

জীবনের কোনো পরিস্থিতিতে কেউ যাতে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আত্মহননের পথ বেছে না নেয় সে দিকে সবার নজর রাখতে হবে। এই বিনাশী পথ থেকে পরিত্রাণে পরিবারের, সমাজের, রাষ্ট্রের দায় আছে। প্রয়োজন পারিবারিক, সামাজিক বন্ধন ও ধর্মীয়-নৈতিক মূল্যবোধ অটুট রাখা।

প্রতিদিন অকাতরে প্রাণ ঝরছে নানান কারণে। হত্যার চেয়ে আত্মহত্যার প্রবণতাই বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, যৌথ পরিবার বিলুপ্তি, সামাজিক এবং পারিবারিক বন্ধনে ফাটল, একঘেয়ে জীবনযাপন, একাকীত্ব, হতাশা, দুশ্চিন্তা, সামাজিক, পারিবারিকভাবে নিগৃহীত হওয়া, অসৎ সঙ্গে মেলামেশা থেকে ধীরে ধীরে তরুণরা বিপথগামী হন। এক সময় বিপদের চরমতম সীমায় পৌঁছেন তারা। পরিণামে আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে এই হতাশা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পান অনেক সময়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এভাবে আত্মহত্যা, আত্মহননের মধ্য দিয়ে একজন মানুষের চিরবিদায় কখনো প্রত্যাশিত হতে পারে না। কারণ প্রতিটি জীবনেরই মূল্য আছে। প্রতিটি মানুষ, সমাজে, সংসারে, দেশের উন্নয়নে, অর্জনে এগিয়ে যাওয়ার পথযাত্রায় কোনো না কোনো ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারেন, পারতেন।

আত্মহত্যা, আত্মহননে মৃত্যুর কথা বলতে গেলে একটি অতি প্রাসঙ্গিক বিষয় বলা দরকার যে, সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি, এর অপব্যবহার, ব্ল্যাকমেলিং প্রভৃতি কারণকে আত্মহত্যা, অপমৃত্যু, অপঘাতে মৃত্যু, আত্মহননের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে দেখছেন সমাজবিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্ধৃতি দিয়ে গণমাধ্যমে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। এতে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত একজন বিবেকসম্পন্ন মানুষকে, সমাজ বিশ্লেষক, সমাজবিজ্ঞানীকে অবশ্যই ভাবায়। সেখানে বলা হয়েছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৩১ জনের প্রাণ যাচ্ছে আত্মহননে। বাস্তবে এই সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। এই তালিকার সর্বশেষ সংযোজন ঘটেছে রাজধানীর বাসাবোর মায়াকাননে। সেখানে একটি বাসায় মা তার গর্ভের প্রিয় মেয়ে শিশুকে গলা টিপে হত্যার পর নিজে রশিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেন। এর আগে গত বছরে বনশ্রীতে মা তার দুই সন্তানতে হত্যা করেন তাদের ভবিষ্যৎ জীবন অনিশ্চিত এবং অন্ধকার ভেবে। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত।

আত্মহননের ঘটনা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল অপেক্ষা শহরাঞ্চলে বেশি ঘটে। তবে এ ক্ষেত্রেও পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের অন্যান্য জেলা, বিভাগীয় শহর অপেক্ষা রাজধানীতে বেশি ঘটে আত্মহননের ঘটনা। এর পরই রয়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল। আবার দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা ও উপজেলাসমূহেও এই প্রবণতা বেশি।

সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানীদের মতে, ইদানীং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা ফেসবুক, ইউটিউব, ইমো ইত্যাদিতে মানুষ বিশেষ করে তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতিসহ মধ্যবয়সীরা অধিক মাত্রায় আসক্ত হয়ে পড়েছেন। বাছবিচার ছাড়া দেখাসাক্ষাৎ, বন্ধুত্ব, প্রণয়, প্রেম, অতঃপর বিরহ, বিচ্ছেদের পরিসমাপ্তি ঘটে আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে। আবার সামাজিক এই যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে অনেক তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতি এমনকি বয়স্করাও ব্ল্যাকমেলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। তখন লোকলজ্জার ভয়ে, রাগে, ক্ষোভে, অপমানের হাত থেকে পরিত্রাণে তারা মুক্তি খোঁজেন আত্মহত্যায়।

সম্প্রতি আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়া সন্তানের উদ্দেশে ফেসবুকে একজনের এমন আবেগঘন পোস্ট চোখ ভিজিয়েছে অনেকের। কিছুদিন আগেই ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন ২০ বছরের মেয়ে চিত্রশিল্পী আফ্রিদা তানজিম মাহি। একটি বৃত্তি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সবকিছু ঠিকঠাক ছিল মেয়েটির। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে গ্যালারি কলা কেন্দ্রে চলছিল তার প্রথম চিত্রকর্ম প্রদর্শনী। সবকিছু এত সাজানো গোছানো থাকার পরও মাহির এভাবে চলে যাওয়া মানতে পারছেন না তার মা। শুধু মাহি নয়, এভাবে জীবনের মায়া ছেড়ে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন বিভিন্ন বয়সীরা। এমন মৃত্যুতে ভেঙে পড়ছেন স্বজনরা। সম্প্রতি সাতক্ষীরার সংসদ সদস্য এডভোকেট মোস্তফা লুৎফুল্লাহর একমাত্র ছেলে অনিক আজিজ (২৬) নিজেদের ফ্ল্যাটে ইন্টারনেটের তার দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। এরপর ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর সবুজবাগে এক গৃহবধূ পারিবারিক অশান্তির জের ধরে প্রথমে দেড় বছরের মেয়েকে হত্যা করেন। তারপর নিজেও ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রিভেনটিং সুইসাইডে বলা হয়, প্রতি বছর বিশ্বে ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে একটি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০২০ সালে এই সংখ্যা প্রতি ২০ সেকেন্ডে একজনে পৌঁছবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গত ৪৫ বছরে আত্মহত্যার ঘটনা ৬০ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্বে বর্তমানে ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সী মানুষের মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের একটি হলো আত্মহত্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানসিক চাপ, হতাশা, অবসাদ ও হেনস্তার শিকার হয়ে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। আবার আর্থ-সামাজিক সমস্যা ও পারিবারিক সংকটের কারণেও অনেকে আত্মহত্যা করে। যুক্তরাষ্ট্রের মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যারা আত্মহত্যা করেন তাদের তিনজনের মধ্যে একজন মাদকাসক্তির কারণে এই পথ বেছে নেন। ৭৫ শতাংশ মাদকাসক্তই আত্মহত্যার চিন্তা করেন। ২০১৬ সালে দেশে আত্মহত্যা করেন ১০ হাজার ৭৪৯ জন। আর ২০১৭ সালে নভেম্বর পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ২৫৬ জন। বছর শেষে এই সংখ্যা বেড়েছে। দুই বছরের এই হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৯ জনের বেশি আত্মহত্যা করছেন। এসব আত্মহত্যার বেশিরভাগই ফাঁসিতে ঝুলে। এ ছাড়া বিষপান ও আগুনে পুড়ে আত্মহননের ঘটনা ঘটছে।

কেন এই আত্মহত্যার প্রবণতা? এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, আত্মহত্যার অনেক কারণ থাকতে পারে। এর একটি হলো মানসিক চাপ। প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু মানসিক চাপ থাকে। তখন জীবন থেকে পালানো বা আত্মহত্যায় মুক্তি খোঁজেন। বিষণ্নতা থেকে এরকম ঘটনা ঘটে। কারণ জীবন নিয়ে তাদের মধ্যে প্রচণ্ড নেতিবাচক ধারণা কাজ করে। এ পর্যায়ে মনে রাখা উচিত সব ধরনের সংকট থেকেই বেরিয়ে আসা সম্ভব। আগের মতো সামাজিক বন্ধন এখন নেই। আত্মহত্যা প্রতিরোধে ওই সামাজিক বন্ধন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা জরুরি। এখন সবাই ঘরমুখী। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও জীবনমুখী নয়। ফলে লেখাপড়া শেষে অনেকে বিষয় অনুযায়ী কাজের সুযোগ পান না। আবার অনেক পরিবার সন্তানের পছন্দ কিংবা মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের পছন্দ তাদের ওপর চাপিয়ে দেন। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। জীবনের কোনো পরিস্থিতিতে কেউ যাতে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আত্মহননের পথ বেছে না নেয় সে দিকে সবার নজর রাখতে হবে। এই বিনাশী পথ থেকে পরিত্রাণে পরিবারের, সমাজের, রাষ্ট্রের দায় আছে। প্রয়োজন পারিবারিক, সামাজিক বন্ধন ও ধর্মীয়-নৈতিক মূল্যবোধ অটুট রাখা।

মোতাহার হোসেন : সাংবাদিক, লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App