×

মুক্তচিন্তা

হ্যারিসন, তোমায় স্মরণ করি

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৭:৩৯ পিএম

বিশ্ব বিবেকের কাছে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত করে বিশ্ববাসীর সমর্থন আদায়ে যে অতুলনীয় ভ‚মিকা রেখেছে হ্যারিসনের কালজয়ী গান, সুরের মূর্ছনা তা আজো অম্লান রয়েছে। বাংলাদেশের আপামর বাঙালি কৃতজ্ঞতাভরে তা মনে রাখবে চিরকাল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে যেসব অবাঙালি মহৎ মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা এবং আত্মত্যাগ রয়েছে জর্জ হ্যারিসন ছিলেন তাঁদের অন্যতম। একাত্তরে নয় মাসব্যাপী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের ওপর পাক হানাদার বাহিনীর নারকীয় তাণ্ডব আর হত্যাযজ্ঞ দেখে কেঁদে উঠেছিল বিশ্ব বিবেক। নানা দেশে ওঠে প্রতিবাদের ঝড়। মানবতাবিরোধী এই গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করতে পৃথিবীর অনেক মানুষ ও সংস্থা থেকে নেয় হয় নানা উদ্যোগ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী জর্জ হ্যারিসন বাংলাদেশের এ দুঃসময়ে অসহায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানোর তাগিদ হৃদয়ে অনুভব করেন। ১৯৪৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যের লিভারপুলে জন্মগ্রহণকারী মাত্র ২৮ বছরের দীর্ঘকেশী ছিপছিপে গড়নের এই যুবক একাত্তরের ১ আগস্ট বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবাদে সোচ্চার হন। বাঙালিদের ওপর নির্মম এ হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ারে হাজারো জনতার সামনে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামে এক কনসার্টের আয়োজন করেন যা বিভিন্ন বিশ্ব মিডিয়ায় বিশেষভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বব ডাইলামসহ ভারতের বিখ্যাত পণ্ডিত রবিশংকর। বাঙালির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় উজ্জীবিত হয়ে হ্যারিসন বাংলাদেশ...বাংলাদেশ... গান গেয়ে কনসার্ট থেকে ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সহায়তার জন্য পাঠান। ইউনিসেফের মাধ্যমে তা ভারতের বন্দিশিবিরে অপুষ্টির শিকার শিশুদের খাবার ও চিকিৎসার জন্য ব্যয় করা হয়। তাঁর হৃদয়কাড়া এ গানে বাংলার মুক্তিপাগল মানুষ, যুদ্ধাক্রান্ত অসহায় নারী শিশুর কান্না ও বেদনার কথা মূর্ত হয়ে ওঠে। বিশ্ববিখ্যাত পপ তারকা হ্যারিসনের এ মহৎ কর্মে অনুপ্রাণিত হয়ে বিভিন্ন দেশ সহায়তার হাত বাড়াতে উদ্বুদ্ধ হয়। ব্যান্ড মিউজিকের পাশাপাশি হ্যারিসন চিরকালই পীড়িত, নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের কল্যাণে এগিয়ে এসেছেন। গানের ভাষায় আর্তমানবতার সেবায় বাড়িয়েছেন সাহায্যের হাত। অতি সাধারণ পরিবারে জন্ম নেয়া হ্যারিসন তখন লিভারপুল ও জার্মানির হামবুর্গের স্কুল সহপাঠীদের নিয়ে গঠিত ‘বিটল’ নামে একটি ব্যান্ডদল চালাতেন। প্রথম জীবনে তিনি একজন গিটারিস্ট হিসেবে পরিচিতি পেলেও পরে একজন সফল গায়ক ও গীতিকার হিসেবে সুখ্যাতি লাভ করেন।

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাঙালির জাতীয় জীবনে দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রাম, শোষণ-বঞ্চনা আর ত্যাগ-তিতিক্ষার সুদীর্ঘ পথ ধরেই একাত্তরে শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে আসে মুক্তিযুদ্ধের ডাক। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে এ দেশের সব মুক্তিকামী মানুষ প্রস্তুতি নিতে থাকে মহান এ যুদ্ধের। ইতোমধ্যে ওড়ানো হয় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। মুক্তিসংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, গ্রামগঞ্জের অগণিত সাধারণ কৃষক, মজুর, শ্রমিক, কবি, লেখক, গায়ক, বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে যুদ্ধে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ। গড়ে তোলা হয় গেরিলা বাহিনী। অনেক বাধা পেরিয়ে নানা ঝুঁকি নিয়ে ভারতে চলে যান অনেকে। সেখানেও গড়ে তোলা হয় ট্রেনিং ক্যাম্প। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সরকারের সব আলোচনাকে ব্যর্থ করে দিয়ে একাত্তরের পঁচিশ মার্চের কালরাতে পাক হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করে। ওরা পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে সব। এক রাতেই হত্যা করে অগণিত সেনাবাহিনী, পুলিশ সদস্য ও সাধারণ মানুষকে। গড়ে ওঠে প্রতিরোধ। শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রাম। পৃথিবীর বন্ধুপ্রতিম দেশ থেকে আসে সাহায্য- সহযোগিতা। মুক্তিযুদ্ধ বেগবান হয়। ভারতের মিত্রবাহিনী মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সর্বাত্মক সাহায্য করে। যারা সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার সুযোগ পাননি তারা লেখালেখি করে, গান গেয়ে বা নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ফান্ড সংগ্রহ করে যুদ্ধে অর্থের জোগান দেন। বন্দিশিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দেন দেশের বহু চিকিৎসক, নার্স। সাধারণ মানুষের ওপর পাক বাহিনীর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ বাড়তে থাকে। ঢাকার মানুষ দিগি¦দিক ছুটে পালাতে থাকে ঢাকা ছেড়ে। পথেও নির্মমভাবে তাদের হত্যা করা হয়। সে যেন এক মৃত্যুমিছিল। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে।

দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের উন্মত্ততার শিকার হন দেশের অগণিত মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষ। ওরা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় বাংলার লাখ লাখ ঘরবাড়ি, হাটবাজার। লুটপাট করে বাংলার মানুষের বেঁচে থাকার শেষ সম্বল । নিরস্ত্র মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। ওদের নৃশংসতা থেকে রক্ষা পায়নি দেশের নারী, শিশুরাও। প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। খাদ্য ও চিকিৎসাসেবা দিতে শত চেষ্টা সত্তে¡ও সেখানে দেখা দেয় মানবিক বিপর্যয়। শরণার্থী শিবিরে প্রায় তিন লাখ শিশু অপুষ্টিতে মারা যায়। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষ শহীদ হন। খুন, ধর্ষণের শিকার হয় দেশের আড়াই লক্ষাধিক নারী। ডিসেম্বরে পাক হানাদার বাহিনী ওদের দোসরদের সহযোগিতায় চালায় এ দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার নৃশংস অভিযান। ওরা বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করে দিতে শেষ চেষ্টায় মেতে ওঠে। বিজয় লাভের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ১৪ ডিসেম্বর ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিল্পীসহ সর্বস্তরের বুদ্ধিজীবীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এসব শহীদের দেহ মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভ‚মিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ফেলে রাখা হয়। গ্রামবাংলার নদ-নদী, খাল-বিলে ভাসতে থাকে অগণিত লাশ। শিয়াল, কুকুর, শকুন ছিঁড়ে খায় বাংলার অগণিত মানুষের গলিত দেহ। মানসিক ভারসাম্যহীন জনগণের একান্ত প্রিয় কথাসাহিত্যিক শহীদ সাবেরকে ওরা ২৬৩ নম্বর বংশালের সংবাদ অফিসে পুড়িয়ে মারে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও প্রায় তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। আসে চ‚ড়ান্ত বিজয়। পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পায় স্বাধীন, সার্বভৌম এক দেশ, বাংলাদেশ।

পঁচাত্তরের ১৫ আসস্ট স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির জনককে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয়। প্রতি বছর শোকাবহ এ মাসটিকে পালন করা হয় যথাযোগ্য মর্যাদায়, পরম শ্রদ্ধায়। আর একাত্তরের আগস্টের ১ তারিখ অমর সঙ্গীতশিল্পী জর্জ হ্যারিসন গেয়েছিলেন সেই কালজয়ী গান। ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রয়াণ দিবসের শোক পালনের সময় আমাদের আত্মত্যাগী জর্জ হ্যারিসনের কথাও মনে পড়ে যায়। তাঁর অবদানের কথা প্রতি বাঙালির মনে তীব্র আলোড়নের সৃষ্টি করে। একজন আমেরিকান হয়েও তিনি দাঁড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে। পরোপকারী, আত্মত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল জীবনের অধিকারী জর্জ হ্যারিসন ২০০১ সালের ২৯ নভেম্বর লসএঞ্জেলেসে এক বন্ধুর বাড়িতে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মুত্যুবরণ করেন। আসলে হ্যারিসনের মতো মানুষের মৃত্যু নেই। চিরঞ্জীব হ্যারিসনরা তো চিরকাল বেঁচে থাকেন পৃথিবীর প্রতিটি শান্তিকামী মানুষের মাঝে। বিশ্ব বিবেকের কাছে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত করে বিশ্ববাসীর সমর্থন আদায়ে যে অতুলনীয় ভ‚মিকা রেখেছে হ্যারিসনের কালজয়ী গান, সুরের মূর্ছনা তা আজো অ¤øান রয়েছে। বাংলাদেশের আপামর বাঙালি কৃতজ্ঞতাভরে তা মনে রাখবে চিরকাল। জর্জ হ্যারিসন বেঁচে থাকবেন সব বাঙালির হৃদয়ের গভীরে, বাংলাদেশের আলো-বাতাসে অনন্তকাল।

১৪ ডিসেম্বর ২০১৭ মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ : প্রাবন্ধিক, গল্পকার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App