×

মুক্তচিন্তা

বিজয় দিবস : জাতীয় ঐক্যের ভাবনা দুর্ভাবনা ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কাহন

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৬:৫৬ পিএম

জাতীয় কিছু মৌলিক বিষয়ে রাজনৈতিক মেরুকরণের মীমাংসা ঘটিয়ে ঐক্যবদ্ধ না হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাজাত প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্পূর্ণ সম্ভব হবে না। আদর্শগতভাবে জয়বাংলা, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা, বুদ্ধিজীবী শহীদের সংখ্যা প্রভৃতি বিষয় স্বীকার না করলে সেসব রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন বাতিলের বিষয়েও চিন্তাভাবনার সময় এসেছে বলে আমরা মনে করি।

কাল-অকালের কাহনকথা

একদিন পর বিজয় দিবস। এই দিবসকে কেন্দ্র করে চারদিকে শুরু হয়েছে নানা রকমের উৎসাহ-উদ্দীপনা আর আয়োজন। এই উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আয়োজন যদি একই লক্ষ্যাভিমুখী হতো তবে বাঙালির ঐক্য প্রকাশিত হতো- যাকে জাতীয় ঐক্য বলা যায়। জাতীয় সব বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারা বা থাকতে না পারা দুঃখজনক এবং লজ্জাজনকও বটে। প্রকৃত বাস্তবতা হলো- আমরা কোনো আনন্দ বা কোনো জাতীয় উৎসব একই কেন্দ্রাভিমুখী উদ্দেশ্যে আয়োজন বা উদযাপন করতে পারি না। কোনো আনন্দ উৎসব কিংবা জাতীয় দিবস পালনের আয়োজনে আমরা এই ঐক্যও প্রদর্শন করতে পারি না। স্বাধীন দেশ। তবু দেশের স্বাধীনতা দিবসকে এবং আসন্ন বিজয় দিবসের আনন্দকেও আমরা নানাভাবে দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছি। দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছি কেবল আমাদের বিশেষ জাতীয় দিবসগুলোকেই নয়- আমাদের রাজনৈতিক জীবনযাত্রার সব আদর্শকেও। একটি স্বাধীন দেশে নানা মত নানা পথ থাকবেই। কিন্তু জাতীয় কিছু স্বীকৃত এবং ঐতিহাসিক বিষয়ে মতপার্থক্য থাকবে এটা মানা যায় না। পৃথিবীতে এমন কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র নেই যারা জাতির পিতাকে মানে না- জাতীয় স্লোগানকে অসম্মান করে। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ব্যঙ্গ করে!

পৃথিবীতে বাংলাদেশের মতো এরূপ দুঃখিনী দেশ খুব কমই আছে- হয়তো একটিও নেই। স্বাধীনতা অর্জনের ৪৬ বছর পরও এখনো এই দেশে ‘স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি’ এই ব্যানারে রাজনীতির নানা স্লোগান ও বক্তব্য-ভাষ্য শুনতে পাই, রাজনীতির চর্চাও দেখতে পাই। যখন আমরা এরূপ ‘স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি’ বলে কিছু দেখি তখন মনে মনে হলেও ‘স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি’ বলে যে কিছু একটা আছে তার অস্তিত্ব স্বীকার করে নেই। স্বীকার করা না করার প্রশ্নও ওঠে না আবার কারণ এটি বাংলাদেশে অত্যন্ত প্রকট রূপেই বিদ্যমান আছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শক্তিকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়ে দেশে ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার দাবিদার গোষ্ঠীটি রাজনীতির মাঠকে এক ভিন্নতর কৌশলের কুরুক্ষেত্র বানিয়ে ছেড়েছে! দলটির প্রতিষ্ঠাতা নিজে মুক্তিযোদ্ধা হয়েও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করলেও দল ভারি করার লক্ষ্যে, সমর্থন বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে, ভোট বাড়ানোর লক্ষ্যে, এক কথায় নিজেকে ক্ষমতার শীর্ষে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের সেইসব বিতর্কিত ব্যক্তি ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে নিজের সেনা-ছত্রছায়ায় এনে দাঁড় করায়। এটিই বাঙালি জাতির এক বিষাদাত্মক ঘটনা- চরম বিপর্যয়। এই ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অন্ধকার মেরুকরণ। তার দলের লোকেরা অদ্ভুত এক ফতোয়া নিয়ে জাতির সামনে উপস্থিত হলো। বলল- ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ বিপক্ষের কথা বলে বিভেদ সৃষ্টি না করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে’ (আশ্চর্য!)। এদের দেয়া ফতোয়া প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি তথা যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষই অবলম্বন করেছিল। শুধু পক্ষাবলম্বনই নয়, জামায়াত, মুসলিম লীগ, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীকে রীতিমতো ‘প্রমোট’ও শুরু করেছিল। এক পর্যায়ে যুদ্ধাপরাধীদের বাড়িতে ও গাড়িতে পতপত করে উড়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। যে পতকা ও রাষ্ট্রটি অর্জনের জন্য ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন প্রায় চার লাখ নারী নির্যাতিত হয়েছেন। বিজয়ের ছেচল্লিশতম বার্ষিকীর প্রাক্কালেও আমরা দেখছি স্বাধীন দেশ। তবুও দেশটি এই এক অদৃশ্য মেরুকরণে আজো বিভক্ত!

রাজনৈতিক মেরুকরণের পাশাপাশি সর্বজন-স্বীকৃত, দেশের আইন ও সংবিধান কর্তৃক গৃহীত এবং মীমাংসিত কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য নানারূপ ‘কু-তর্ক’ উসকে দিতে দেখি। এমনকি একাধিকবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ নির্বাহীর পদে আসীন থাকার পরও সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধে এদেশের শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে জনসমক্ষে তির্যক বক্তব্য প্রদান করেন। অথচ ২৫ মার্চ পরিচালিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এ এক রাতেই নিহত হয়েছিল ৮০ হাজারের বেশি বিভিন্ন শ্রেণিপেশার বেসামরিক বাঙালি। আর জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার জরিপে দেখা যায়, বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে অল্প সময়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ হত্যা করা হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে। ২৫ মার্চের পর থেকে বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৬ হাজার থেকে ১২ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে পাকিস্তানি নরপিশাচের দল। অথচ বক্তব্য প্রদানের সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি নেত্রী পাকিস্তানিদের কণ্ঠেই যেন কথা বলেন!

মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, ৭ই মার্চের ভাষণকে কটাক্ষ করে যে রাজনীতির চর্চা তা যে কখনোই বর্ণিত ‘স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি’ নয় সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এভাবে ওই রাজনৈতিক দল এবং তার সঙ্গে জোটভুক্ত অন্যরাও যে প্রগতিশীল চিন্তার ধারক তা কোনোভাবেই বলা যাবে না। জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ এবং তাদের আদর্শ অনুসারী কিছু সংখ্যক দল বিএনপির সঙ্গে ‘বিশ দলীয়’ নামে গোত্রভুক্ত হয়েছে। এদের কীভাবে জাতি ‘স্বাধীনতার পক্ষ’ শক্তি বলে শনাক্ত করবে? যেসব রাজনৈতিক দল আদর্শগতভাবে জয় বাংলা, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা, বুদ্ধিজীবী শহীদের সংখ্যা প্রভৃতি বিষয় স্বীকার করতে চায় না তারা কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিরূপে নিজেদের প্রকাশ ও প্রমাণ করবে তাও সাধারণের বোধগম্য নয়। ১৬ ডিসেম্বর সবাই যার যার মতো বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠবে সন্দেহ নেই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভ‚লুণ্ঠিত করে এভাবে বিভিন্ন জাতীয় দিবস আর কত উদযাপন করা হবে? সুতরাং এই দ্বিধাবিভক্তি নিয়েই এবারের বিজয় দিবসের আনন্দের দিনটিও অতিক্রান্ত হয়ে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাবে অনেক উচ্চারিত ও অনুচ্চারিত বিষয়েও।

জাতীয় কিছু মৌলিক বিষয়ে রাজনৈতিক মেরুকরণের মীমাংসা ঘটিয়ে ঐক্যবদ্ধ না হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাজাত প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্পূর্ণ সম্ভব হবে না। আদর্শগতভাবে জয়বাংলা, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা, বুদ্ধিজীবী শহীদের সংখ্যা প্রভৃতি বিষয় স্বীকার না করলে সেসব রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন বাতিলের বিষয়েও চিন্তাভাবনার সময় এসেছে বলে আমরা মনে করি। নতুন প্রজন্মের দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের কাছে আমরা এরূপ প্রত্যাশা রেখে গেলাম।

আর মাত্র কটি বছর পর আমরা উদযাপন করব স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী, বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী। তখন আমাদের সম্মুখে কোনো বাস্তবতা বিরাজ করবে জানি না। তবে এমন আশা কি আমরা করতে পারি না যে, স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীর সময় সব প্রশ্নের মীমাংসা ঘটে কেবল ‘স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি’ই সেই উৎসবের আয়োজন করবে! প্রতিষ্ঠিত হবে জাতীয় ঐক্য! এমত আশা আমরা কি করতে পারি না যে, অন্তত সুবর্ণ জয়ন্তীর সময় আমরা দেখতে পাব বৈষম্যহীন একটি শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি সম্পন্ন এক বাংলাদেশের! যেখানে এখনো আমরা দেখতে পাই সার্বিকভাবে নানা ধরনের উন্নয়ন সাধিত হলেও ধনী-দরিদ্রের আয় বৈষম্যের পার্থক্য ব্যাপক। দেশে শিক্ষিত জনসংখ্যার হার বহুলাংশে বৃদ্ধি পেলেও দক্ষ জনশক্তির অভাব আমাদের এক বড় সংকট। দক্ষ জনশক্তি আমদানির পশ্চাতে আমাদের জাতীয় অর্থের ব্যাপক অপচয় সামগ্রিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের অর্থনৈতিক অপচয়কে রোধ করতে হবে। আমাদের রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থার সংস্কার বিগত ছেচল্লিশ বছরে যতটুকু প্রত্যাশিত ছিল আমরা তার দোরগোড়ায় পৌঁছাতে পারিনি। আবার বিপরীতক্রমে আমরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে আগে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলো থেকে অনেকটাই এগিয়ে যেতে পেরেছি। তবে এ কথাও সত্য যে, আমাদের দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, প্রশাসনিক কাঠামোর সক্ষমতা এবং আইনের শাসন ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান থাকলে আমরা আরো বহুদূরে এগিয়ে যেত পারতাম। আমাদের মাথাপিছু আয় কিংবা জিডিপির স্বাস্থ্যকর অবস্থা দেখতে পেতাম।

আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গৌরব করে নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের বয়ান দিতে চাই তারা কিন্তু তাদের কাছ থেকে প্রায়শ বিব্রতকর এরূপ প্রশ্নের মুখোমুখি হই যে, স্বাধীনতার পরও কেন এই দ্বিধাবিভক্তি? যারা স্বাধীনতাকেই সম্মান দেবে না, যারা স্বাধীনতাকে মেনে নেবে না তারা কেন স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করবে? ছেচল্লিশ বছরেও কেন আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জনে পিছিয়ে আছি? কেনই বা আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত নেই? কেনই বা প্রশাসনিক কাঠামো এখনো দুর্বল? নতুন প্রজন্মের কাছে প্রশ্নের কোনো শেষ নেই। সব প্রশ্নের মীমাংসা সম্ভব হতো যদি মৌলিক কিছু জাতীয় বিষয়ে আমরা আমাদের রাজনৈতিক দ্বিধাদ্ব›দ্ব দূর করতে সমর্থ হতাম। সব দুর্ভাবনাকে পশ্চাতে ঠেলে নতুন প্রজন্মের কাছে এই এক ইতিবাচক ভাবনায় নিজেকে যুক্ত ও নিবেদন করে বলি- তোমাদের কাছেই রেখে গেলাম বিশ্ব, তোমাদের রেখে গেলাম বাংলাদেশ- আমার সোনার বাংলা।

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App