×

মুক্তচিন্তা

শান্তি প্রক্রিয়ায় ট্রাম্পের কুঠারাঘাত

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৭:০৫ পিএম

বিশ্ব সম্প্রদায় ও ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পরে জেরুজালেমের জিম্মাদার জর্ডানের সব সতর্কতা, আশঙ্কা ও হুঁশিয়ারিকে পাশ কাটিয়ে গত বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন দূতাবাস তেলআবিব থেকে সরিয়ে জেরুজালেমে স্থানান্তরের ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। মূলত তার এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়া বিশেষ করে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি আলোচনার শেষ আশাটুকু তিনি শেষ করে দিলেন। অথচ এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই ছিল ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি প্রত্যাবর্তন করার শেষ ভরসা বা শান্তির রক্ষাকর্তা!

যে জেরুজালেমকে ট্রাম্প ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন সেই জেরুজালেম পবিত্র শহর হিসেবে সবার কাছে প্রসিদ্ধ। একদিকে পবিত্র শহর, অন্যদিকে তিন ধর্মের তীর্থস্থান। বলা চলে এটা বিশ্বরাজনীতির পীঠস্থান, বিশ্বশান্তি বা অশান্তির সূতিকাগারও। অনেকে তাই বলেন- জেরুজালেম শান্ত তো পৃথিবী শান্ত, আর জেরুজালেম অশান্ত তো বিশ্ব অশান্ত। এ জেরুজালেমকে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল উভয়ই রাজধানী হিসেবে পেতে চায়। তাদের এ চাওয়ার মধ্যেই শুরু হয় দ্ব›দ্ব ও সংঘাত আর। এ সংঘাত বিদ্যমান রয়েছে দশকের পর দশক। দুপক্ষই জেরুজালেমকে নিজেদের বলে দাবি করে আসছে, ফলে প্রচুর প্রাণহানি ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্র এতদিন নীরব থেকেছে এবং কাউকে সমর্থন দেননি। বিষয়টি পুনরায় আলোচনায় আসে গত মার্কিন নির্বাচনের সময়, যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নিজের নির্বাচনী ইশতেহারে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেন। আর এটি অন্তর্ভুক্ত করতে তাকে সহায়তা করেন ডেভিড ফ্রিডম্যান। যিনি বর্তমানে ইসরায়েলে মার্কিন দূত হিসেবে কর্মরত আছেন।

ট্রাম্পের ঘোষণার পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় তার মিত্র দেশ ইংল্যান্ড, সৌদি আরব, জার্মানি, রাশিয়া, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ফ্রান্স। এ ছাড়াও মুসলিম প্রায় সবকটি দেশ এমনকি পোপ বেনেডিকও এই ঘোষণার বিরুদ্ধে নিজের অভিমত ব্যক্ত করেন। ট্রাম্পের এ বক্তব্যের কড়া প্রতিবাদ জানায় ফিলিস্তিন, তুরস্ক, ইরান, মালয়েশিয়া, লেবানন, সিরিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ। আরব লিগ, ওআইসি ও জাতিসংঘ তাদের ত্বরিত সভা ডাকে। বিশ্বকর্তারা সবাই একে যুদ্ধের সংকেত হিসেবে দেখলেও ট্রাম্প দেখছেন ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের মধ্যে শান্তির প্রথম রূপরেখা হিসেবে!

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের পর যুক্তরাষ্ট্র খুব লাভবান হবে এমনটা মনে হয় না এবং আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বনেতৃত্ব দিতে গেলে এ সিদ্ধান্ত বাধা হয়ে আসতে পারে। কেননা ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে প্রধান মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এতদিন যে নীতির কারণে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছিল কিংবা শান্তি প্রক্রিয়ার শেষ বীজ বুনেছিল তা চিরতরে নিঃশেষ করে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারাল। সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রকে আর কোনো দেশই কোনো বিষয়ে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বিশ্বাস করবে না। ট্রাম্প তার এ সিদ্ধান্তে কেবল পুরো জেরুজালেমকে ইসরায়েলের বলে স্বীকৃতিই দেননি বরং গায়ের জোর আর অস্ত্রের মাধ্যমে অবৈধ দখলদারিত্বকেও তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন কেননা ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় ইসরায়েল এই জেরুজালেম দখলে নেয়, কিন্তু বিষয়টি অন্যায় ও এর ঐতিহাসিক কোনো ভিত্তি না থাকায় তখন বিশ্ব তাতে সমর্থন দেয়নি। ট্রাম্প ঐতিহাসিক ভিত্তিকে বাদ দিয়ে কেবল অস্ত্রের মাধ্যমে পাওয়া দখলদারিত্বকে স্বীকার করে পুরো বিশ্বকে কলঙ্কিত করছেন।

ট্রাম্প এ ঘোষণা দেয়ার আগে অতীতের দুদেশের করা চুক্তিগুলোর দিকে একবারের জন্যও লক্ষ রাখেননি যেখানে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল উভয়ই নিজেদের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে জেরুজালেমের কর্তৃত্ব বিষয়ক দ্বন্দ্বের সমাধান করবে বলে একাধিক চুক্তিতে সই করেছে। যেমন- ১৯৯৫ সালে ইসরায়েল ও ইয়াসির আরাফাতের পিএলওর মধ্যে অসলো চুক্তিতে উভয়পক্ষ জেরুজালেম প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারিত হবে বলে মেনে নেয়। এরপর যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট হিসেবে আখ্যা পাওয়া জর্জ বুশের শাসনামলে তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হোয়াইট হাউসের লনে ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত ও ইসরায়েলি নেতা র‌্যাবিনের মধ্যে যে শান্তি আলোচনা হয় তাতেও জেরুজালেম প্রশ্নে উভয়েরই সম্মতি ছিল।

এ কথা সবারই জানা যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে ইসরায়েলি প্রভাব অত্যধিক। যার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন পার্লামেন্টে ইসরায়েলবান্ধব অনেক আইন পাস হয়েছে যা কখনো কখনো মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়েছে। আর সেই মনোভাবের কারণেই কেবল যুক্তরাষ্ট্রের এমন সিদ্ধান্ত কিংবা ঘোষণা দেয়াটা সম্ভব হয়েছে। ট্রাম্প একবারের জন্যও চিন্তা করেননি যে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেছেন সেই জেরুজালেমে ফিলিস্তিনের হাজার হাজার নাগরিকের বসবাস কিংবা আবাসস্থল। ধনীদের ওপর কর কমানো এবং ছয়টি মুসলিম বিশ্বের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার কারণে ট্রাম্প যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন তা ঢাকতেই তিনি জেরুজালেমের ব্যাপারে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে অনেকে মনে করছেন। কিন্তু ট্রাম্পের এহেন চিন্তাধারাকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অভিনব ষড়ষন্ত্র বলে অভিহিত করাই সমীচীন হবে। কেননা ট্রাম্প এমন এক সময় এ ঘোষণাটা দিলেন যখন ফিলিস্তিন ও আরব বিশ্ব বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। আর এ বিভক্তির সুযোগটাই কি ট্রাম্প গ্রহণ করলেন?

ট্রাম্প এ সুযোগে মুসলিম বিশ্বের যেসব দেশের নিজেদের মধ্যে ঐক্য রয়েছে তাতে চিড় ধরাতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলেও অনুমান করা হচ্ছে। কেননা, এসব নীতি অবলম্বন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই সফল হয়েছে।

যার কারণে সৌদি আরব ইসরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্বের ঘোষণা দিয়েছে একমাত্র ইরানকে একঘরে করার উদ্দেশ্য নিয়ে। আর মিসর ও আরব আমিরাতের রাজ্যগুলো এই আঁতাতের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লেবাননে, সিরিয়ায় কামানের আওয়াজ এখনো শোনা যাচ্ছে। বলা চলে, এটিই যুক্তরাষ্ট্রের মূল পলিসি, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যার প্রথম স্তর ছিল আরব বসন্ত আর দ্বিতীয় স্তর হলো মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে অন্তঃকলহ তৈরি করে দেয়া। আর এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সব সময় মধ্যপ্রাচ্যকে ট্রাম্পকার্ড হিসেবে বেছে নিয়েছে। এবারের ট্রাম্পের ঘোষণাটাও তার ব্যতিক্রম নয় বলে মনে হয়।

সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো- যে ঘোষণা নিয়ে পুরো পৃথিবী প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে সেই ঘোষণাকে ট্রাম্প শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে উল্লেখ করেন। অবশ্য অধিকাংশ বিশ্বনেতা একে শান্তি প্রক্রিয়ার মৃত্যু বলে অভিহিত করেছেন। এমনকি অনেক মার্কিনিও একে শান্তির প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মনে করেন না। কেননা তাদের মতে, এর উদ্দেশ্য- নিজের দলের রক্ষণশীল লোকদের মধ্যে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করা। শুধু মার্কিন ইহুদি লবি নয় বরং রিপাবলিকানদের মধ্যে যারা ইভানজেলিকের অংশ তারাও এ সিদ্ধান্তে তাদের সন্তুষ্টি ব্যক্ত করেছে। ফলে আগামী নির্বাচনে রিপাবলিকানদের ইভানজেলিকের পক্ষ থেকে সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।

জেরুজালেমকে ইসরায়েলিরা তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে। তাদের যুক্তি- তিন হাজার বছর আগে ইহুদিরা এ শহর গড়েছে। তবে তাদের এ ধারণার মূলে কোনো ঐতিহাসিক কোনো ভিত্তি নেই। সম্প্রতি জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর এক প্রস্তাবে জেরুজালেমের ওপর ইসরায়েলের দাবিকে ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করেছে।

ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সব ধর্মের লোক এই জেরুজালেমে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করে যার যার ধর্ম পালন করে আসছিল। কিন্তু ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। সুতরাং এ দ্ব›দ্ব ও সংঘাত থেকে বিরত রেখে সবাইকে শান্তিপূর্ণ বসবাস নিশ্চিত করে স্ব-স্ব ধর্ম পালনে পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী ঘোষণা দিয়ে একে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়া এবং পশ্চিম জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে এ অঞ্চলে কয়েক দশক ধরে চলে আসা যুদ্ধের দামামা বন্ধ করে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের বিরূপ ফলাফল সামনে রেখে পুরো বিশ্ব মার্কিন প্রেসিডেন্টকে তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে। এ মুহ‚র্তে মুসলিম বিশ্বের ঐক্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। মুসলিম বিশ্বের মধ্যে একনিষ্ঠ ঐক্য ও সমমনা দেশগুলোর সাহায্য নিয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নিতে পারলে এ বিষয়ে খুব বেশি কিছু হবে বলে মনে হয় না।

শরীফুর রহমান আদিল : শিক্ষক, লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App