×

মুক্তচিন্তা

অরণ্যের দিনরাত্রি

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৮:১৭ পিএম

সময়ের কথা

এক. অরণ্যের কথা বছর দশেক আগে সম্ভবত টেলিভিশনে ‘তৃতীয় মাত্রা’ নামে টকশো চালু হয়। শুরুর আগে টাইটেল সঙ্গীত হিসেবে ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ গানটির দুটি লাইন গাওয়া হতো। গানটি আমার খুব ভালো লাগত। অনুষ্ঠানটির জন্য আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম। অনুষ্ঠানটি শুরু হলেই আমি দৌড়ে এসে টিভির সামনে বসে পড়তাম। গানটি শেষ হলেই আমি উঠে যেতাম। কিন্তু কোথায় যাব? ছোট্ট একটি বাড়ি। দুটি মাত্র রুম। মা-বাবার কাছে ওই গানটি সম্পূর্ণ শুনেছিলাম অনেকবার। আমার খুউব ভালো লাগত। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বাবার ছোট্ট বেলার গল্পগুলো মনে করতাম। বাবার জন্ম গ্রামে। ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।’ আমাদের দেশটা এত সুন্দর? এটা কি সত্যি? তাহলে আমাদের দেশ ছেড়ে অনেকে ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায় চলে যায় কেন? এখনো যাচ্ছে। আমাদের দেশটা যদি এত সুন্দর হবে, তাহলে মানুষ এ দেশ ছেড়ে চলে যায় কেন? সঙ্গীতকার কি মিথ্যা লিখেছেন? ‘চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা, কোথায় উজল এমন ধারা।’ কোথায় চন্দ্র সূর্য? আমার বাসা অন্ধকার। চারধারে উঁচু উঁচু দালান। কোনোদিক থেকেই তো চাঁদ সূর্য দেখা যায় না। আমি আলো খুব পছন্দ করি। আমার বাবা কত গল্প করত, তার ছোটবেলার গল্প। সেখানে সূর্য ছিল, চন্দ্র ছিল, আকাশ ভর্তি তারা ছিল। আর আমি একটা ছোট্ট বাড়িতে বন্দি। মা-বাবা দুজনেই সকালে কাজে চলে যায়। আসে সেই রাতে। কোনো দিন আমি আগেই ঘুমিয়ে যেতাম। রাবেয়াই আমাকে দেখাশোনা করে। খাওয়ায়। রাবেয়া আমাকে খুব আদর করে। ওর বাড়িতেও আমার মতো একটি ছেলে আছে। ছেলের কথা মনে করে মাঝে মাঝে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদত। আমি বলতাম ‘কেঁদো না। আমি তো আছি।’ তখন সে আমাকে আরো জোরে জরিয়ে ধরে আরো জোরে কেঁদে উঠত। আমার মা-বাবা কখনো তার কান্না শোনেনি। আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করতাম ‘তুমি কি ধানের খেতের ওপর বাতাসের ঢেউ খেলতে দেখেছো?’ বাবা বলতেন, ‘হ্যাঁ, দেখেছি। তার মধ্যেই তো আমরা বড় হয়েছি।’ ভাবলাম বাবা বড় ভাগ্যবান! বাবা যখন তার ছোটবেলার গল্প শোনাত, মনে হতো ‘শিশুহন্তা’ ঢাকা শহর ছেড়ে আমি একদৌড়ে বাবার গ্রামে ছুটে যাই।

বাবাকে জিজ্ঞেস করতাম ‘তুমি কেন তোমার সেই স্বপ্ন দিয়ে তৈরি স্মৃতি দিয়ে ঘেরা গ্রাম ছেড়ে চলে এলে!’ বাবা আজকের সমাজ বাস্তবতায় গ্রামের সুযোগের অভাবের কথা তুলে ধরত। গ্রামে চাকরি নেই, ভালো স্কুল নেই, চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম এতটুকু খাঁচার মধ্যে আমাদের ‘ধনধান্যে পুষ্পভরা’ দেশটিকে খুঁজে পাও?’ বাবা আমার কথা শুনে অবাক হতো, আশ্চর্য হতো! মা’র সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করত। আমি নাকি এক ব্যতিক্রমী শিশু। মা-বাবা রাতে যখন আমাকে নিয়ে আলাপ করত, মাঝে মাঝে আমি তা শুনতাম। তারা আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখত। আমি অনেক বড় হব। মাঝেমধ্যে বাবা চাকরি ছেড়ে দেয়ার কথা বলত। আমার তখন দারুণ আনন্দ হতো। কিন্তু তার আর চাকরি ছাড়া হলো না। ছুটির দিনে মাঝেমধ্যে বাবা আমাকে বাইরে কোনো পার্কে নিয়ে যেত। কিন্তু বাতাসে ভেসে থাকা ধুলোয় সূর্য স্লান-মলিন হয়ে থাকত- বিকট শব্দে কান ফেটে যেত। আমার মতো ছোট ছেলেমেয়েরা হৈহুল্লোড় করে খেলা করত। কিন্তু বায়ু ও শব্দদূষণ আমি সহ্য করতে পারতাম না। আমার মনে হতো বাবার বাড়ির পাশ দিয়ে চলা পদ্মার একটি শাখা নদীর কথা। বাবার বন্ধুবান্ধবরা সেখানে হুটোপুটি করত। বাবার কত বন্ধু ছিল। কেউ গরু চড়াত, কেউ বা খেতে লাঙল দিত। বাবাও। আমার কোনো বন্ধু নেই। রাবেয়াই সব।

দুই. বাবার কথা আমার চার বছরের ছেলের বুদ্ধি দেখে আমরা অবাক হয়ে যেতাম। এইটুকু ছেলের এত বুদ্ধি! এতো স্মরণ শক্তি। ছ’মাস আগে আমার এক বন্ধু সাদা শার্ট পরে এসেছিল। পরে যখন এল, তখন সে বলল ‘আংকেল, তোমার সেই সাদা শার্টটা আর পরো না?’ আমরা অবাক হয়ে যাই। সে সময় পেলে অনবরত কথা বলত- প্রশ্ন করত। মনে হতো দশ/বারো বছরের ছেলে। এমন সব প্রশ্ন করত যার উত্তর দেয়া সম্ভব হতো না। একদিন ঘুমের মধ্যে গান গেয়ে উঠল ‘আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি।’ শুনে আমাদের মনটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। তাকে ঢাকার পাশের এক গ্রামে নিয়ে গেলাম। সে বলল, ‘এটা গ্রাম না। আমি তোমার গ্রামে যেতে চাই। আকাশে যেতে চাই, চন্দ্র সূর্যের কাছে যেতে চাই।’ আমি বলি ‘বাবা একদিন নিয়ে যাব।’ বাংলাদেশের প্রতি এত দরদ এতটুকু ছেলের মধ্যে এল কী করে? এ কি ডিএল রায়ের গানের প্রভাব?

তিন. অরণ্যের কথা মা-বাবা সারাদিন বাড়িতে থাকে না। আমার মোটেই ভালো লাগে না। রাতে এসে তারা খাবারের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমাকে একটু আদর করার সময়ও পায় না। কিন্তু তারা আমাকে তাদের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখি ‘পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখা, কুঞ্জে কুঞ্জে গাছে পাখি; গুঞ্জরিয়া আসে অলি পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে, তারা ফুলের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে।’ আহা, আমি যদি মৌমাছির মতো উড়তে পারতাম। ফুলের মধু খেয়ে ফুলের ওপর ঘুমিয়ে পড়তাম। কী মজা হতো!

ঢাকার শব্দ ও বায়ুদূষণে আমি নিঃশ্বাস নিতে পারি না। চারধারে মাইকের শব্দে কান ফেটে যায়। কান চেপে ধরেও সে শব্দ থেকে উদ্ধার পাই না। আমাদের বিল্ডিংয়ের চারপাশে অনেকগুলো প্রাথমিক স্কুল ও কোচিং সেন্টারের জন্য সন্ধ্যার পরও স্বস্তি পাই না। রাত দুটো/তিনটায় হর্নের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। মাইক দিয়ে আজকাল রাতে-দিনে যখন তখন সুপার মার্কেটের বিশেষ ছাড়ের কর্কশ চিৎকার। অসহ্য! দরজা-জানালা বন্ধ গুমট ঘরেও রেহাই নেই। তাই ঢাকায় আমার থাকতে ইচ্ছা করে না। পূর্ণিমার গোল চাঁদ দেখাতে একদিন মা-বাবা আমাকে ন’তলার ছাদে নিয়ে গিয়েছিল। আকাশ ভর্তি তারা দেখেছিলাম। মা-বাবা বলে আমার দাদা-নানা তারা হয়ে আকাশে আলো ছড়ায়। বাবাকে বলি ‘আমিও তারা হতে চাই। দাদা-নানার কাছে যাব।’ মা-বাবা বলে ‘বালাই ষাট।’ তাদের মুখে যেন চিন্তার ছাপ পড়ে।

সবাই বলে আমার নাকি তীক্ষ্ম বুদ্ধি। এই বয়সে সাধারণত দেখা যায় না। আমি যখন বলি, ‘তোমাদের এত টাকার দরকার? যখন আমি থাকব না, বুঝবে তখন বুঝবে।’ আমার কথা শুনে মা’র সঙ্গে রাবেয়ার চোখ দিয়ে জল পড়ে। বলে ‘ছি বাবা, এসব কথা বলতে নেই।’ কিন্তু না বললেও কি যা হওয়ার তা ঠেকানো যায়? একদিন দুপুর বেলায় আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে থাকে। ঘরের দরজার তালা বন্ধ। রাবেয়া ফোন করে বাবাকে খবর দিলে মা-বাবা দুজনেই ছুটে আসে ঢাকার তীব্র যানজট ডিঙিয়ে এক ঘণ্টারও পর। দরজার বাইরে বিল্ডিংয়ের ক’জন দাঁড়িয়ে আছে। রাবেয়ার কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। দরজা খুলে দেখা গেল অরণ্য একটি ছোট্ট তারা হয়ে দাদা-নানার পাশে আকাশে জায়গা করে নিয়েছে।

বাবা বলেন, এর জন্য আমিই দায়ী। আমি তাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলাম। সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশের একটি ছবি তার মনে এঁকে দিয়েছিলাম। ষাট বছর আগে এক নিভৃত গ্রামে জন্মগ্রহণ, গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়া, তারপর তিন/চার মাইল মেঠোপথ হেঁটে হাইস্কুলে যাওয়া, বৃষ্টির মধ্যে গ্রামের খোলা মাঠে বাতাবি লেবু দিয়ে ফুটবল খেলা, বৃষ্টিতে ভিজে আম কুড়ানো, ছিপ দিয়ে মাছ ধরা, ঢেঁকি দিয়ে আউশের ধানের চাল, ঢেঁকির শব্দ, পাখির কুজন, পরিষ্কার-স্বচ্ছ বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়া, স্বচ্ছ নীল আকাশের গল্প আমিই তাকে শুনিয়েছিলাম। সে স্বপ্ন দেখতে শিখেছিল। ওই রকম গ্রামের। বর্তমান সভ্যতা সম্পর্কে তার তেমন জ্ঞান ছিল না। থাকার কথাও না। গ্রামও সে আজ আর সেরকম নেই। শহরের যাবতীয় ক্লেদ গ্রামকে কলুষিত করে তুলেছে।

চার. উপসংহার ছেলেটির বাবা তার বিল্ডিংয়ের ছাদে বিগত পাঁচ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে একটি অরণ্য গড়ে তুলে অরণ্যের অভাব ভুলতে চান। ন’তলার ওপর সে অরণ্যে নেই এমন কোনো গাছ নেই। দারুচিনি, মৌরি, বাসক, শিউলি থেকে শুরু করে আম-জাম-কাঁঠাল-লাউয়ের সবুজ পাতায় তিনি ছাদকে সত্যি একটি মনোরম অরণ্য গড়ে তুলেছেন। বিল্ডিংয়ের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের অবাধ বিচরণ সে অরণ্যে।

এ সত্যি কথাগুলো বলতে বলতে ভদ্রলোকের চোখ ভিজে এল। ঢাকার নির্মম অমানবিক পরিবেশ ছেড়ে অরণ্য মুক্ত, স্বচ্ছ-নীলাকাশে হাজার হাজার তারার মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। ৩ ডিসেম্বর, ২০১৭

শহিদুল ইসলাম : সাবেক অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App