×

মুক্তচিন্তা

রোহিঙ্গা সংকট ও তার দুরূহ সমাধান

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৮:২৬ পিএম

একে একে পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব দেশের সরকারের প্রতিনিধিরা এসে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের করুণ অবস্থা দেখে গেলেন। তাদের কেউই মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবতাবিরোধী অপরাধ করেনি, এরূপ কথা বলেননি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরাসরি উপস্থিত হয়ে বিতাড়িত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের সঙ্গে কথা বলে তারা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছেন- কী ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। রোহিঙ্গাদের খুব কম মহিলাই পাওয়া গেছে, যারা ধর্ষিত হয়নি। নাবালিকা কিশোরীদেরও রেহাই দেয়নি দুর্বৃত্তরা। ধর্ষণকে তারা রাজনৈতিক যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। ইসলাম ধর্মে নারীকে যে মর্যাদা দেয়া হয়েছে, মুসলিম রোহিঙ্গা নারীদের ওপর ধর্ষণ চালিয়ে এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছে দেয়া হয়েছে যে, সতীত্ব ও জীবন রক্ষার প্রয়োজনে তারা দেশ, বাড়ি, সংসার, ভিটেমাটি, আসবাবপত্র, গরু-বাছুর, আত্মীয়-স্বজন সব ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। বিশ্ব সভ্যতার এক মহাকলঙ্ক হচ্ছে যুদ্ধকালীন নারী ধর্ষণ। বাংলাদেশের মানুষ তাই গভীর বেদনার সঙ্গে স্মরণ করে থাকে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সরকারিভাবে আড়াই লাখ মা-বোনের কথা বলা হলেও কমপক্ষে ১০ লাখ বাঙালি নারী ধর্ষণ করা হয়েছিল। পৃথিবীর যেখানে এথনিক ক্লিনজিং চলেছে, সেখানেই নারী ধর্ষণ এক বাস্তবতা। যে কোনো যুদ্ধে রক্তপাত ঘটে, ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে, প্রাণহানিও ঘটে কিন্তু নারী ধর্ষণের মতো আত্মবিধ্বংসী জঘন্য প্রক্রিয়ায় মানবতা সবচেয়ে বেশি বিপন্ন হয়। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। একাধিকবার ধর্ষিত একজন রোহিঙ্গা নারী শুধু জীবনটা নিয়ে বাংলাদেশে পাড়ি দিয়েছে। এদের সঙ্গে কথা বললেই বুঝা যায়, কী নিদারুণ মানসিক চাপে এখনো তারা দিন কাটাচ্ছে। হত্যা ও নিধনযজ্ঞ তো এখনো চলছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে, সম্পত্তি দখল করে, বেছে বেছে যুবকদের হত্যা করে, ক্ষেতের ফসল, গোয়ালের গরু-ছাগল, ভেড়া-মুরগি-হাঁস সবকিছুই ধ্বংস করে দেয়া হয়। বাড়িঘর ভেঙে এমন সমতল ভ‚মির সৃষ্টি করা হয়েছে যে, একজন রোহিঙ্গা পরিবার দেশে ফিরে গিয়ে কোথায় তার ঘর ছিল, কোথায় ছিল শস্যক্ষেত্র তার কিছুই খুঁজে বের করতে পারবে না। তাদের সবকিছুই সেনাবাহিনী দখল করে নিয়েছে। বলা হচ্ছে- এখন নাকি তাদের ফিরিয়ে নিয়ে তাদের বাড়িঘরে পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ দেয়া হবে না। নবগঠিত ক্যাম্পে অর্থাৎ বন্দিশালায় তাদের বসবাস করতে হবে। কাজকর্ম, জীবনযাত্রার প্রণালি, জীবনধারায় সবকিছুতে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করবে। এই যদি বাস্তবতা হয়, তাহলে কি কোনো রোহিঙ্গা দেশে ফিরে যেতে চাইবে? এও বলা হয়েছে প্রতি মাসে যাচাই-বাছাই করে মাত্র তিন হাজার রোহিঙ্গা ফেরত নেয়া হবে। তাদের হিসাবে মাসে ৩ হাজার রোহিঙ্গা অর্থাৎ বছরে ৩৬ হাজার হয়। তাহলে ১০ লাখ রোহিঙ্গা ফেরত নিতে কত যুগ লাগতে পারে? তাহলে এই সংকটের প্রকৃতি গিয়ে দাঁড়াবে কোথায়? নারী, শিশুরা ও বৃদ্ধরা যে অবস্থায় শরণার্থী ক্যাম্পে দিন কাটাচ্ছেন, তাতে করে আগামী শীতকালে অগণিত মানুষ মৃত্যুবরণ করবে বলে মনে হয়। বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এবং বিশ্বের বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার সাহায্য সত্তে¡ও অগণিত মানুষের মৃত্যু ঠেকানো যাবে বলে মনে হয় না।

একমাত্র চীন ও রাশিয়া ছাড়া রোহিঙ্গা সংকট দ্রুত সমাধানের পথে কেউ বাধা সৃষ্টি করেনি। তবে এই সংকট সমাধানে চীন ও রাশিয়ার যে কোনো আগ্রহ নেই, বাস্তবতা কিন্তু তা নয়। এই দুটি দেশের ওপর মিয়ানমারের বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেই দিয়েছেন যে, দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চালিয়ে যেতে তার দেশ সহযোগিতা করবে। জাতিসংঘের প্রস্তাবে ভারত ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকলেও রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে ভারত তার আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। ভারত রোহিঙ্গা সংকটের ব্যাপারে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। যেহেতু সম্প্রতি এশিয়া কেন্দ্রিক চীন এবং ভারতের সহযোগিতা একান্তভাবে প্রয়োজন, তাছাড়া চীনের রয়েছে নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রয়োগের অধিকার। পশ্চিমা দুনিয়া মানবিক কারণে এই সংকটের সমাধানের পথে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেও দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর দ্রুত সহযোগিতার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া চীন ও ভারত এশিয়ার দুই বৃহৎ শক্তিশালী দেশ হওয়ার কারণে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া জাতিসংঘের পক্ষে এই সংকটের সমাধান সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। ভেটো প্রদানের অধিকারী দেশগুলোর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হলো- চীন ও রাশিয়া। সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদের যে কোনো প্রস্তাব নাকচ করে দিতে পারে। উত্থাপিত প্রস্তাব বারবার ভেটো দিয়ে নাকচ করা হলে যে কোনো সংকট সমাধানের পথ খুঁজে বের করা জাতিসংঘের পক্ষে দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে। প্রায় ৩ মাস তো অতিবাহিত হয়ে গেল, এখনো তো যুক্তিসঙ্গতভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো কিছুরই সমাধান হয়নি। মিয়ানমার সরকার সম্পর্কে তো সবাই অবগত আছেন যে, গণতন্ত্র ও মানবিকতা, জনগণের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতার মতো কোনো কিছুই তো মিয়ানমার সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। নোবেল লরেট সু কি ওই দেশের নির্বাচিত সরকার হলেও গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির কারণে কোনো কিছুতেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সেনাবাহিনীর সিদ্ধান্তই সেখানে শেষ কথা। সু কি ও তার দলের কথামতো রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমার তার দায়িত্ব পালন করছে বলে মনে হয় না। সরকারের ওপর যে ধরনের কমান্ড থাকলে সু কি নিজেই সমাধানের পথ বাতলে দিতে পারতেন তা আর নেই। বরং তার অস্তিত্ব সেনাবাহিনীর অনুকম্পার ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ দেশ তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে মিয়ানমারে কী ঘটেছে, তা সশরীরে দেখে গেছেন ও স্ব-স্ব সরকারের কাছে প্রতিবেদন পেশ করেছেন। মানবতার এই চরম বিপর্যয়কে কেউ সমর্থন জানায়নি। সেখানে যে জেনোসাইড, এথনিক ক্লিনজিং কারণ হিসেবে পরিদৃষ্ট হয়েছে। মানবতার চরম লঙ্ঘনও ঘটেছে। এতসব দেশের প্রতিনিধিরাই জেনে গেছেন বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামে রোহিঙ্গা সর্বজনগ্রাহ্য সংকট সমাধানের পথেও সবাই সমানভাবে আগ্রহী। এরূপ বাস্তবতায় পৃথিবীর শক্তিধর দেশগুলোর দ্রুত সমাধানের পথ খুঁজে বের করা দরকার। বাংলাদেশের মতো জনবহুল সমস্যা সংকুল দেশের পক্ষে ১০ লাখ বিদেশি নাগরিককে বছরের পর বছর ভরণপোষণ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। রোহিঙ্গা সংকট আজ সমস্বরে বিশ্ব নেতাদের বিভিন্ন ফোরামে সমর্থিত হচ্ছে। বিশ্ব বিবেকের সাড়াও জেগেছে। এত বড় মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধী ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি উঠেছে আন্তর্জাতিক ক্রাইম সংস্থা (ICT) থেকে। আজ হোক, কাল হোক এ বিচার হতেই হবে। তবে আশু সংকট হচ্ছে- এই ১০ লাখ অভিবাসীকে মিয়ানমারে তাদের ভিটামাটি বা বাড়িতে ফেরত দেয়া। সত্যই পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিয়ে যাতে তারা স্বদেশে বাস করতে পারে, এরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ। এত স্বল্প সময়ে এত বৃহৎ সংকট বিশ্বের আর কোথাও সৃষ্টি হয়নি। তাই বিশ্বের কাছে এটাই সবচেয়ে বড় বিদ্যমান সমস্যা। এর সমাধানও হতে হবে দ্রুত। কোনো প্রকারে এ সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক মহাশক্তি পরস্পর বিরোধিতায় নিমগ্ন হওয়া ঠিক হবে না। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানিসহ পশ্চিমা দুনিয়া বিশেষ আগ্রহ দেখাচ্ছে বলেও প্রাচ্যের শক্তিধর দেশগুলো যেন প্রতিপক্ষ হয়ে না দাঁড়ায়। এটা একটা মহামানবিক সমস্যা। সেভাবেই এ সংকটের প্রতি সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হওয়া দরকার। এটা উত্তর কোরিয়ার বা সৃষ্ট আণবিক সংকটও নয়। মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক সৃষ্ট এক মিয়ানমার সংকট। বিশ্বের সব দেশের মানুষও এই সংকটে সাড়া দিয়েছে। পাঠিয়েছে সাহায্য সামগ্রী, ওষুধপত্র, জ্বালানিসহ আরো অনেক কিছু। তবে এই সাহায্য সরবরাহ সুদীর্ঘ দিন অব্যাহত থাকবে বলে মনে হয় না। আর বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয় ১০ লাখ রোহিঙ্গার ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয়া। এরই মধ্যে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। হঠাৎ করে পরিস্থিতি চরম অবনতিশীল হতে পারে। তাই সময় থাকতে এই সংকটের সমাধান হওয়া দরকার। এ রূপ এক ভয়াবহ সংকটে যদি জাতিসংঘ তার দায়িত্ব পালন করতে না পারে, তাহলে জাতিসংঘ থেকে লাভ কী? বিশ্বের পরাশক্তিগুলো বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধকৌশল নির্ধারণ করে বিশ্বব্যাপী তাদের প্রভাব বলয় টিকিয়ে রাখে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নন। কিন্তু মানবতাই যেখানে বিপন্ন, সেখানে পরাশক্তিগুলোর কি কোনোই দায়িত্ব নেই?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App