×

মুক্তচিন্তা

সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দিতে হলে ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন’ তৈরি করতে হবে

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:৫৯ পিএম

 

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা ঘটেই চলেছে। ফেসবুকে ধর্ম অবমাননা বা যে কোনো অজুহাতেই আজ সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে তাদের ঘরবাড়ি-মন্দির ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে, লুটতরাজ করা হচ্ছে, ভিটেছাড়া করা হচ্ছে। এসব প্রতিরোধে রাজনৈতিক দল, সরকার, প্রশাসনের কাক্সিক্ষত ভ‚মিকা দেখা যাচ্ছে না। দিনে দিনে বাংলাদেশ সংখ্যালঘুশূন্য হতে চলেছে। এ দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন- এর উদ্দেশ্য, প্রকৃতি, কীভাবে এসব প্রতিহত করা যায়, এ নিয়ে ভোরের কাগজের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ভোরের কাগজের সিনিয়র রিপোর্টার এন রায় রাজা।

ভোরের কাগজ : বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের একের পর এক ঘটনা ঘটে চলছে। ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, দেশত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে- এটিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

রানা দাশগুপ্ত : প্রথম কথাটা হচ্ছে এসব বিষয় কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে আমার মনে হয় না। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে বিগত ৪২ বছরে বারে বারে আমরা এগুলো প্রত্যক্ষ করেছি। এছাড়া পাকিস্তানের ২৫ বছরেও এ ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। তখন পাকিস্তান সরকার এবং সে সরকারের যারা তল্পিবাহক ছিল, মূলত তারা এ ঘটনাগুলো ঘটিয়েছিল। যার উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান থেকে মাইনরিটিদের বিতাড়ন করা। কারণ তারা ভেবেছিল পাকিস্তানকে যদি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে হয় তাহলে সংখ্যালঘুদের তাড়াতে হবে। এট দি টাইম অব ইমারজেন্সি পাকিস্তান ২৯.৭ পার্সেন্ট ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। তাই যারা ১৯৪৭-এ পাকিস্তান রাষ্ট্রটি চেয়েছিলেন তারা যে উদ্দেশ্য নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি করেছিলেন এবং ইসলামিক স্টেট এ ২৯.৭ পার্সেন্ট মাইনরিটি রেখে প্রকৃতার্থে পাকিস্তানকে তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করা যাবে না বলে ভেবেই এ কাজ করেছেন। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বাঙালিরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, এখন যারা রাষ্ট্রভাষা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেন তারা ভাবলেন ইস্ট পাকিস্তানে সাড়ে ৭ কোটি মানুষের মধ্যে ৪ কোটি ছিল বাঙালি আর বাকিরা ছিল পাকিস্তানের। অথচ উর্দুভাষী ছিল ২-৩ পার্সেন্ট। তারা ভেবেছিল বাংলাভাষার দাবি যারা তুলত, তাদের কমাতে হবে। দাবিটা তুলেছিল ১৯৪৮-এ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত এবং তিনি সেখানে যুক্তি তুলেছিলেন ইস্ট পাকিস্তানে মেজরিটি মানুষ বাংলায় কথা বলে, তাহলে এটা কেন ওয়ান অব দ্য স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ হবে না। এরপর থেকে ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীকে মাইনরিটিকরণের জন্য সংখ্যালঘু বিতাড়নের শুরু। এটা আমরা পাকিস্তানের ২৫ বছরে দেখেছি। তাই এটাকে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করলে ভুল হবে, এটা পরিকল্পিত।

ভোরের কাগজ : মুক্তিযুদ্ধের সংবিধানের চার মূলনীতি এবং সংখ্যালঘু নির্যাতন- কীভাবে দেখেন?

রানা দাশগুপ্ত : একদিকে ধর্মীয় বৈষম্য, অন্যদিকে জাতিগত বৈষম্য। বৈষম্য থেকে মুক্তি এবং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষার ভিত্তিতেই তো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হলো। যে দিন বাংলাদেশে প্রবাসী সরকার গঠিত হলো, তার আগেই কিন্তু স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষিত হয়েছিল। যেখানে বলা হয়েছিল- এমন একটি রাষ্ট্রের জন্য আমরা লড়াই করছি, যে রাষ্ট্রটি হলে পরে সব নাগরিকের ইকুইটি ইকুয়্যালিটি এবং সোশ্যাল জাস্টিস অর্থাৎ সাম্য, সমতা এবং সামাজিক মর্যাদাটি সুনিশ্চিত হবে এবং এটা হবে বাঙালির বাংলাদেশ- সে যে ধর্মের বা বর্ণেরই হোক না কেন। সব ধর্ম বর্ণের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল আন্ডার দ্য লিডারশিপ অব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আলটিমেটলি সব বাঙালির ত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশটি অর্জন করেছি। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের যে সংবিধানটি গৃহীত হলো সেই সংবিধানটি গৃহীত হওয়ার মধ্য দিয়েই কিন্তু চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ঘোষণা করা হলো। তার আবর্তেই কিন্তু আসলে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ এবং তার আগের লড়াইয়ের আকাক্সক্ষা যা ছিল, সেটারই প্রতিফলন ঘটল। কিন্তু আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করলাম, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে খুন করার পর যে রাষ্ট্র ক্ষমতার নাটকীয় পরিবর্তন হলো এই নাটকীয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যখন জিয়াউর রহমান সাহেব ক্ষমতায় আসলেন, তিনি সামরিক ফরমান বলে একটি গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের সাম্প্রদায়িকীকরণ করলেন। সেই থেকে শুরু। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পরে খন্দকার মোস্তাক ক্ষমতায় এলেন। এরপরই কিন্তু সাম্প্রদায়িক প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়ে গেল। কিন্তু সংবিধানটির সাম্প্রদায়িকীকরণ করলেন জিয়াউর রহমান সাহেব। এর পরে ওটাতে আরো রাষ্ট্রধর্মের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা আরোপ করে ঢুকিয়ে দিলেন জেনারেল এরশাদ। আমরা কিন্তু আগের সেই পাকিস্তান আমলের মতো লক্ষ করলাম ১৯৭৫-এর পরে বাংলাদেশের যে রাষ্ট্র ও প্রশাসন ঠিক পাকিস্তানের আবরণে চলে গেল এবং নির্যাতন, নিপীড়ন এবং বৈষম্য ঠিক পাকিস্তানের আদলেই শুরু হলো মূলত ১৯৭৫-এর পরে। একই ছায়ার ২০০৬ সাল পর্যন্ত অসংখ্য ঘটনা আমরা দেখেছি। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যখন বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ক্ষমতায় এল তখন আমরা আশা করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রাষ্ট্রটি পরিচালিত হবে এবং এর আগে যা কিছু নির্যাতন, নিপীড়ন, বৈষম্য হয়েছে তার অবসান হবে। এটা আমরা সঙ্গত কারণে আশা করেছিলাম। কিন্তু ২০১১ সালের মাঝামাঝি থেকে এ পর্যন্ত সময়, অর্থাৎ রংপুর পর্যন্ত সময়টার মধ্যে আমাদের হিসাব মতে শত শত ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যেই ঘটে গেছে কোনোটা ছোট বা কোনোটা বড় ঘটনা কিন্তু একনাগাড়েই চলছে। কিন্তু সেখানে আমরা রাষ্ট্র প্রশাসনের কোনো ভূমিকা দেখতে পাচ্ছি না। হামলা হয়ে যাওয়ার পরে সান্ত্বনা দেয়ার নামে আমরা কিছু লোক দেখানো কার্যক্রম লক্ষ করেছি।

ভোরের কাগজ : আসলে কারা ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?

রানা দাশগুপ্ত : এই ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে মূলত তারাই, যারা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার দখলদার বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের নির্মূল ও নিশ্চিহ্ন করার অভিপ্রায়ে লিপ্ত ছিল, যারা সে সময় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশে নানা অপরাধে লিপ্ত হয়েছিল এবং বর্তমানে তাদের বিচার চলছে। তাদেরই প্রেতাত্মারা এ ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে।

ভোরের কাগজ : অনেক সময় সরকারি দলের নেতাকর্মীরা এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে খবর আসে- এ বিষয়ে আপনার অভিমত কি?

রানা দাশগুপ্ত : দুঃখের বিষয় যে, সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে মন্ত্রী, নেতা এবং কর্মীদের একাংশ এদের সঙ্গে মেলবন্ধনে জায়গাজমি দখল, লুটপাটের ঘটনাগুলো লিপ্ত হতে আমরা লক্ষ করছি। আমরা যদি পাবনার সাঁথিয়ার দিকে তাকাই, রামুর উখিয়া টেকনাফের দিকে তাকাই, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের দিকে তাকাই, দিনাজপুরের চিরিরবন্দর, সাতক্ষীরার ফতেপুরের দিকেও তাকাই, সবখানের দৃশ্যটাকে কিন্তু একই রকমের মনে হয়। যেমন- অতি সাম্প্রতিককালের রংপুরের ঘটনা, এখানে হামলা করবে বলে হামলাকারীরা ৫ দিন ধরে পরিকল্পনা করেছে। এরা সংঘবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু আমরা ওখানকার সরকারি দলের নেতাকর্মীদের এই পরিকল্পনাগুলো ব্যর্থ করার অথবা এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর রাজনৈতিক কোনো ভ‚মিকা দেখতে পাইনি। সরকার ও প্রশাসনের কোনো ভ‚মিকা আমরা লক্ষ করিনি। যদি তারা আগে থেকেই এ পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিতে পারত তাহলে যে ঘরবাড়ি জ্বলেছে তাও ঘটত না, আবার যে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে তাও ঘটত না। ঘটনাগুলো ঘটার পরে কোথাও চাল নিয়ে যাওয়া হয়, কোথাও টিন নিয়ে যাওয়া হয়, কোথাও পুনর্বাসনের কথা বলা হয়। কিন্তু কথাটি হলো পুনর্বাসন করে কি লাভ যদি না আপনি সংখ্যালঘু নাগরিকের মনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারেন।

ভোরের কাগজ : সরকারের সদিচ্ছা-ভূমিকা নিয়ে কি বলবেন? সংখ্যালঘুরা কি আজ অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে?

রানা দাশগুপ্ত : নিয়োগ বা পদোন্নতির ক্ষেত্রে আগে যে বৈষম্য ছিল গত কয়েক বছরে তার কিছু অবসানের দিক আমরা লক্ষ করেছিলাম। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ওগুলো দিয়েও আপনি সান্ত¡না দিতে পারবেন না। যদি না তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হন। সত্যি কথা বলতে চাই- ১৯৭০ বছরের মধ্যে আমাদের কাছে মনে হয়, আমরা আজকাল অস্তিত্বের সংকটে পড়ছি। এই অস্তিত্বের সংকটের মধ্য থেকে উত্তরণ এবং সমমর্যাদা ও সমধিকারের দাবি নিয়ে ২০১৫ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমরা লাখো মানুষের সমাবেশ করেছিলাম। সে সমাবেশ থেকে আমরা রাষ্ট্রের কাছে এ দাবিগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছি যে, বর্তমান আমলে দেশের সংখ্যালঘুরা অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে।

সংখ্যালঘু সমস্যাটিকে এখন জাতীয় সমস্যা হিসেবে বিবেচনার সময় এসেছে। যদি জাতীয় সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে জাতীয়ভাবে সমাধানের দিকে না যাওয়া যায় তাহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হবে। হয়তো দেশ কোনো নতুন ষড়যন্ত্রের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। কিন্তু আমরা চাই না বাংলাদেশ কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার হোক। অতএব আমাদের দায়িত্ব হলো আজকে আমাদের গণতান্ত্রিক ও তান্ত্রিকভাবে সাম্য, সমতা ও সামাজিক ন্যায় বিচারের ও মানবাধিকারের লড়াইটিকে এগিয়ে নেয়া।

ভোরের কাগজ : বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা কতটা সমমর্যাদা, সাম্য ও ন্যায়বিচার পাচ্ছে বলে মনে করেন?

রানা দাশগুপ্ত : প্রশ্ন হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত যখন মনে করে এ দেশে সংখ্যালঘুরা আপদ, তখন সংখ্যালঘুরা মনে করে আওয়ামী লীগ আমাদের আশ্রয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যখন নির্যাতিত হয় তখন মনে করে তারা অনুগ্রহের পাত্র-দাস। তখন তার মধ্যে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক- নাগরিক হিসেবে নাগরিকের মর্যাদাটা যথোপযুক্ত ভোগ করার জন্যই তো আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। তাহলে এই নাগরিকের মর্যাটা আমরা পাব কখন? কেন আমরা নিগৃহীত, নির্যাতিত, অবহেলিত?

ভোরের কাগজ : দিনে দিনে সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছে, এটি কিসের সংকেত?

রানা দাশগুপ্ত : আজ ভাবার বিষয়- ১৯৪৭-এ পাকিস্তান-ভারত বিভক্তির সময় আমরা ছিলাম ২৯.৭ শতাংশ, ১৯৭০ সালে ২০ শতাংশ সংখ্যালঘু জনগণ ছিল, এই ২০ শতাংশ জনগণ সে দিন ৬ দফার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তারা গণহত্যার শিকার হয়েছে, ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়েছে, কিন্তু তারা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল একটি স্বাধীন দেশের জন্য। আজকে সরকারি হিসাব মতে সংখ্যালঘুরা ২০ শতাংশ থেকে ৯.৭ শতাংশে নেমে এল কেন? যদি এভাবে হুমকি, হামলা, নির্যাতন, দখলবাজি অব্যাহত থাকে এবং মানুষ যদি অধিকতর নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে পার্শ্ববর্তী দেশে দেশ ত্যাগে অব্যাহত থাকে, তাহলে বাংলাদেশ সংখ্যালঘুশূন্য হতে আর কয় বছর এ রাষ্ট্রটিকে অপেক্ষা করতে হবে। আর সংখ্যালঘুশূন্য যদি হারিয়ে যায়, যদি সর্বধর্মের বাংলাদেশ হারিয়ে যায় তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, আমার ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের কি হবে। গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎটা কি হবে। এটা ঠিক আমাদের উন্নতি হচ্ছে, সমৃদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু সংখ্যালঘুদের যদি দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা হয় তাহলে এসব উন্নয়ন-সমৃদ্ধিতে তাদের কি আসে যায়? আর আমরা যেটা মনে করি তা হলো সংখ্যালঘু থাকা মানে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব থাকা, মুক্তিযুদ্ধের অস্তিত্ব থাকা। সংখ্যালঘুশূন্য যদি বাংলাদেশ হয়ে পড়ে এ দেশ গণতন্ত্রশূন্য হয়ে যাবে। শুধু তাই না, উপমহাদেশজুড়ে নতুন সংকট শুরু হয়ে যাবে। দেশ এ আবর্তে পড়ূক এর জন্য তো আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি।

ভোরের কাগজ : সরকারের প্রধান বলছেন, তিনি সংখ্যালঘুদের অধিকারের ব্যাপারে আন্তরিক, অথচ বাস্তবে আমরা ভিন্ন চিত্র দেখছি। তাহলে সরকারের ভেতরে কি ছায়া সরকার কাজ করছে?

রানা দাশগুপ্ত : প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার- তাজউদ্দীন সরকারের মধ্যেও আমরা পাকিস্তান সরকারের ছায়া সরকার দেখেছি। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর সরকারে আমরা ছায়া সরকার দেখেছি। এ ছায়া সরকার কি করেছে তা আমরা ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট লক্ষ করেছি। কি করেছে তা সবাই জানে। আজকেও কেন যেন আমাদের মনে হয়, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারে এবং দলে কেন জানি একটা সাম্প্রদায়িক ছায়া সরকার কাজ করছে, মোশতাকের প্রেতাত্মারা কাজ করছে। যে কারণে আমাদের মনে হয়, প্রধানমন্ত্রীর অনেক আন্তরিকতা থাকা সত্তে¡ও তার আন্তরিকতাগুলোকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে তার সরকার ও দলে ঘাপটি মেরে থাকা মোশতাকীয় প্রেতাত্মারা।

ভোরের কাগজ : সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধে সরকারের কাছে আপনাদের কি প্রত্যাশা?

রানা দাশগুপ্ত : সরকারি দলের প্রধান ও সরকারকে বলি- এই বাংলাদেশের জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি। প্রকৃতার্তে সামাজিক সাম্য, সমতা ও অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। যখন আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম তখন কে কোন ধর্মের তা মনে করে যুদ্ধে নামিনি। তাই কনটেক্সটে যতক্ষণ বাঙালিকে রক্ষার জন্য বাংলাদেশ রাষ্ট্র এগিয়ে আসবে না, যতদিন সংখ্যালঘুদের আপদ বা অনুগ্রহের চোখে বিবেচনা করা হবে, সমতা ও সাম্য নিশ্চিত হবে না, তাহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ হবে অন্ধকার। সরকার বা রাষ্ট্রের কর্তব্য সব ধর্মের মানুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করা। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি অতি সাম্প্রতিক রংপুরের ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা তারই বহিঃপ্রকাশ। এটি পূর্বপরিকল্পিত।

ভোরের কাগজ : রংপুরের ঘটনায় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে অভিমত কি?

রানা দাশগুপ্ত : রংপুরে প্রশাসন এমন কিছু ঘটতে পারে তা আগেই জানত, তাহলে এখানে প্রশাসন নিষ্ক্রিয় থাকছে কেন? আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো বলেছেন, আমাদের গোয়েন্দা বাহিনীর এ বিষয়টি আগেভাগেই জানা। তাহলে কেন প্রিভেনটিভ মেজর নেয়া হলো না। কেন নিষ্ক্রিয় থাকল। এর জবাব তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দিতে হবে। দায়িত্ব তো তাকে নিতে হবে। তাকে তো এ কথা জবাব দিতে হবে। যদি আপনার মন্ত্রণালয় আগেই জেনে থাকে এখানে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে চলেছে তাহলে কেন আগেই ব্যবস্থা নিল না। পুলিশ এই প্রথম কোনো ঘটনার এক্ট করল। যদি আগেই এর প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া যেত তাহলে এই অপ্রীতিকর ঘটনা তো ঘটত না। কোনো প্রয়োজন ছিল না।

অবার অদ্ভুত ঘটনা যে, টিটু রায়ের নামে মিথ্যে পোস্টিং দেয়া হলো সে কিন্তু রিমান্ডে, কিন্তু যিনি সেই ইসলামী আন্দোলনের নেতা, যিনি পোস্টটি করে প্রকৃত ধর্মের অবমাননা করলেন, যার জন্য এত বড় ঘটনা ঘটল, যে প্রকৃত দোষী সেই খুলনার হুজুরকে কিন্তু গ্রেপ্তার করা হলো না। কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। তাকে গ্রেপ্তার করলেই বোঝা যাবে এর প্রকৃত উদ্দেশ্য কি। হি ইজ দ্য রুট। কারা বারবার ফেসবুকে এসব ধর্মের অবমানকর পোস্টিং দিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে, এটা বের করা দরকার। প্রকৃত দোষী কারা। তাদের আইডেন্টিফাই করা হচ্ছে না কেন? তাহলে তো প্রকৃত কারণ বেরিয়ে আসবে। যখন ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে পোস্টিং দেয়া হয় তখন তো তাৎক্ষণিকভাবে তা বের করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়, আসামি ধরা হয়, বিচার হয়। তাহলে এসব ক্ষেত্রে যারা ধর্মীয় অবমাননার জিগির তুলে বড় বড় ঘটনা ঘটাচ্ছে কেন তা বের করা হচ্ছে না। প্রকৃত কারা দোষী। ঘটনাগুলো করার জন্য যারা ফেসবুকের মাধ্যম ব্যবহার করে অশান্তি সৃষ্টি করছে তাদের কেন বের করা হচ্ছে না। এটা তো আমাদের গোয়েন্দা বাহিনীর কাজ। এটাকে তো তাদের আইডেন্টিফাই করা তাদের কাজ। এটিকে যদি বের করা না হয় তাহলে বুঝতে হবে সরকারের মধ্যে কোনো চক্রান্ত রয়েছে, যে প্রতাত্মা সরকারে রয়েছে তারা সরকারের ভাবমূর্তি ও উন্নয়নকে নস্যাৎ করে জনগণ থেকে সরকারকে বিচ্ছিন্ন করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা রয়েছে এদের। এ সরকারের ভাবমূর্তি দেশে ও বিদেশে নষ্ট করার জন্য সরকারের অভ্যন্তর থেকে কোন চক্র কাজ করে যাচ্ছে। এদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন।

ভোরের কাগজ : আগামী নির্বাচনে সংখ্যালঘুরা কি নির্ভয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে?

রানা দাশগুপ্ত : সামনে নির্বাচন- এ হুমকি হামলা মামলা অব্যাহত থাকলে দেশের ৯.৭ শতাংশ সংখ্যালঘুরা ভোট দিতে যাবে কিনা তা তারা ভেবে দেখবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে বলব, সেই জায়গায় এদের ঠেলে দেবেন না, দেশের ভোটারদের ১১.৮ শতাংশ ভোট সংখ্যালঘুদের। তারা এবার শঙ্কিত, তারা ভোট দেবে কিনা ভেবে দেখবে। আপনি ভোটও নেবেন, আবার নিরাপত্তা দেবেন না, এটা তো হতে পারে না। নিরাপত্তা, সমানাধিকার, ন্যায়বিচারÑ এটা নিশ্চিত করা সাংবিধানিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এটা সব রাজনৈতিক দলগুলোকে ভাবতে হবে।

ভোরের কাগজ : রংপুরের ঘটনার পরে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের টুইট বার্তা- এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

রানা দাশগুপ্ত : আমাদের কাছে একান্ত লজ্জার। এখানে ঘটনা ঘটছে আর ভারতের তরফ থেকে বলা হচ্ছে আমরা উদ্বিগ্ন। ভারতের তরফ থেকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতায় ভারত উদ্বিগ্ন। আজকে সেখানেও কিন্তু কথা উঠে গেছে- বিভিন্ন কারণে ভারতে যে ১ কোটি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান আশ্রয় নিয়েছে তাদের ভারত আর নিরাপত্তা দিতে পারবে না বলে জানিয়েছে। অথচ ৬ মাস আগেই বলেছিল এদের নাগরিকত্ব দেবে। শরণার্থীর মর্যাদা দেবে।

ভোরের কাগজ : সাম্প্রদায়িক হামলা-নির্যাতনকে জাতীয় সমস্যা বলে কি আপনি মনে করেন?

রানা দাশগুপ্ত : সব মিলিয়ে সমস্যাটা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের সমস্যা নয়, সমস্যাটিকে এখন জাতীয় সমস্যা হিসেবে বিবেচনার সময় এসেছে। যদি জাতীয় সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে জাতীয়ভাবে সমাধানের দিকে না যাওয়া যায় তাহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হবে। হয়তো দেশ কোনো নতুন ষড়যন্ত্রের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। কিন্তু আমরা চাই না বাংলাদেশ কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার হোক। অতএব আমাদের দায়িত্ব হলো আজকে আমাদের গণতান্ত্রিক ও তান্ত্রিকভাবে সাম্য, সমতা ও সামাজিক ন্যায় বিচারের ও মানবাধিকারের লড়াইটিকে এগিয়ে নেয়া।

ভোরের কাগজ : সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধে ঐক্য পরিষদের ভূমিকা কি?

রানা দাশগুপ্ত : এর জন্য আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৭ দফা দাবি তুলে ধরেছিলাম। এটা ছিল একটা মাইনরিটি প্যাকেজ। আগামী জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে আমরা ৫ দফা দাবি রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তুলে ধরেছি। আমাদের উদ্দেশ্য হলো- সব রাজনৈতিক দলের কাছে সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিরাজিত সমস্যা ও সমস্যাগুলো সমাধানের উপায় নিয়ে আলোচনা করা এবং সব রাজনৈতিক দল যাতে এ সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসে সে বিষয়ে কথা বলার একটা সিদ্ধান্ত আমাদের ছিল। সে প্রেক্ষাপট নিয়ে আমরা কিন্তু এ কথাগুলো বলেছি। আমরা মনে করি পার্লামেন্টে গণতান্ত্রিক পন্থায় সরকারি ও বিরোধী দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান রেরিয়ে আসতে পারে। পার্লামেন্টে এ আলোচনা উঠুক এবং এর সমাধান হোক তা চাই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App