×

মুক্তচিন্তা

মাতৃভূমি মিয়ানমারের ওপর রোহিঙ্গাদের অধিকার

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:৪২ পিএম

সামরিক শাসন-নিয়ন্ত্রিত মিয়ানমার সরকারকে এই গণহত্যা থেকে ফেরানোর জন্য আন্তর্জাতিক নিন্দা ও নরম উদ্যোগই যথেষ্ট হতে পারে। এক্ষেত্রে মিয়ানমারের আশপাশের ও দূরের শক্তিশালী দেশগুলো কার্যকর ভ‚মিকা পালন করতে পারে। সভ্যতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিশতে হলে যে গণহত্যা গ্রহণযোগ্য নয়, এই সত্য প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া রোহিঙ্গাদের দুর্দশার কথা কোনো কাজে লাগবে না। নিজ বাসভূমে ফিরে স্বাধীন নাগরিক হিসেবে নিজ জীবন পরিচালনার অধিকার লাভ ছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যার প্রকৃত পূর্ণ সমাধান নেই।

রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে। কোথাও উন্নতির তেমন লক্ষণ নেই। তবে রোহিঙ্গা নিয়ে আলোচনার কমতি নেই, বলা যায় বেড়েছে। কিন্তু আলোচনার কোনো উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়ছে না সংকট থেকে মুক্তির দিকে। বিশেষ করে যারা সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারেন তাদের মাঝে কোনো পরিবর্তন নেই। বার্মায় রোহিঙ্গা মুসলমানের ওপর নির্যাতন ও বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে তাদের সমস্যাগুলো মূল আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। নিজ মাতৃভ‚মি মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বাস করার অনস্বীকার্য অধিকার নিয়ে তেমন কারো মাথাব্যথা নেই।

গণহত্যা বন্ধ করতেও রোহিঙ্গাদের সব অধিকার ফিরিয়ে দিতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী-শাসিত সরকারকে বাধ্য করা এখন জরুরি। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন করে এই জরুরি কাজটি সম্পন্ন করার সব অধিকার সে দেশের জনগণের। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এ অধিকার বাস্তবায়নের সামর্থ্য জনগণের নেই। গত নির্বাচনে তারা কেবল আংশিক সাফল্য অর্জন করেছে যার মধ্য দিয়ে সু কি ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু আসলে তিনি ক্ষমতাহীন। আর এখন রোহিঙ্গা প্রশ্নে যে রকম সুবিধাবাদী অনৈতিক অবস্থান তিনি নিয়েছেন, তাতে তারও পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। যদিও আপাতত সে সম্ভাবনা ক্ষীণ।

ক্ষমতার রদবদল ছাড়াও সে দেশের সরকারের ওপর ভেতর ও বাহির থেকে চাপ সৃষ্টি করে জাতিগত নিধনযজ্ঞ থেকে সরকারকে সরানো যেতে পারে। ভেতর থেকে কার্যকর চাপের সম্ভাবনা কম বলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব অনেক বেশি। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও পশ্চিমা ক্ষমতাশালী ধনী দেশগুলো সফলভাবে এই চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

এই চাপ দেয়া হচ্ছে না ও মিয়ানমার সরকারকে বাধ্য করা হচ্ছে না সভ্য দুনিয়ার উপযোগী আচরণ করতে। তার কারণ যারা এই চাপ দিতে পারে তাদের চোখ বন্ধ করে থাকা। তারা রোহিঙ্গাদের দুর্দশা নিয়ে কুমিরের কান্না কাঁদছেন বটে, কিন্তু সমস্যার প্রকৃত সমাধানে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। আন্তর্জাতিক চেষ্টা নিবদ্ধ হয়েছে রোহিঙ্গাদের সমস্যা শরণার্থী হিসেবে যতটা দূর করা যায় তার মধ্যে। যার ফল হবে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘমেয়াদি শরণার্থী জীবন। মাতৃভূমি মিয়ানমারে স্বাধীন নাগরিক হিসেবে তাদের বেঁচে থাকার অধিকারের কথাটা প্রায় উহ্যই থেকে যাচ্ছে।

রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে এশিয়ান ও পশ্চিমা দেশগুলোর এই কার্যত নীরবতার কারণ ক্ষমতাসীন মিয়ানমার সরকারের কাছ থেকে স্বার্থ হাসিল। রোহিঙ্গা নিয়ে নাকি কান্না কেঁদে তারা বিপন্ন মানবতার কাছে তাদের দায় সারতে চায়। অথচ যে কোনো ছুতোনাতায় ন্যায়-অন্যায় সব উপায়ে তারা তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোয় হস্তক্ষেপ করে থাকে। নিজেদের দেশে গণতন্ত্রের বালাই না থাকলেও কোনো উঠতি দেশে গণতন্ত্রের পান থেকে চুন খসামাত্র তাদের সব সাংঘাতিক সাংবাদিক ও বন্দুক-কামান নিয়ে ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তাদের সে গরজ নেই। দক্ষিণ এশিয়ায় বিপন্ন মানবতাকে বাঁচানোর সব দায়িত্ব বাংলাদেশের কিছু গরিব মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে।

বাংলাদেশের মানুষ ধনী না হলেও এ দায়িত্ব যথাসাধ্য পালন করছে। নির্যাতিত হয়ে দেশ থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দিকে তারা উদার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ধনী দেশগুলোর বহুল প্রচারিত মানবতাবাদীদের এখান থেকে শিক্ষণীয় বহু কিছু আছে। অন্য দেশ থেকে আগত আশ্রয়প্রার্থীদের ব্যাপারে তাদের অনেকেরই অ্যালার্জি সর্বজনবিদিত। কিন্তু বাংলাদেশে কক্সবাজারের সাধারণ মানুষ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি যে সহনশীলতা ও সহানুভূতি দেখিয়েছে তা দৃষ্টান্তমূলক। তারপরও আবেগ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। স্থায়ী হতে গেলে কোনো কিছুর বস্তুগত ভিত্তি থাকতে হয়। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আবেগেও তাই এক সময় ভাটা পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।

স্পষ্টতই রোহিঙ্গা সংকট দিন দিন আরো জটিল ও খারাপ হচ্ছে। খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, কিছু শিক্ষা, কিছু ওষুধপত্র ইত্যাদি কিছু মৌলিক প্রয়োজন পূরণের চেষ্টা ছাড়া সাহায্য সংস্থাগুলো আর কী বা করতে পারে। এসব সামান্য চাহিদা পূরণ তাই বলে তাদের মূল অধিকার, তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাস করার বিকল্প হতে পারে না।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নিজ বাসভূমে স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাস করার অধিকারের কথা পাশ কাটিয়ে তাদের কল্যাণের চেষ্টা করলে মিয়ানমার সরকারকে অবাধে গণহত্যা চালিয়ে যাওয়ার লাইসেন্স দেয়া হবে। এতে আরো যেসব সরকার প্রকাশ্যে ও গোপনে জাতিগত নিধনযজ্ঞে লিপ্ত তাদেরও এসব অপরাধ চালিয়ে যাওয়ার সবুজ সংকেত দেয়া হবে। অযোগ্য সরকারগুলো অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এসব মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড করে থাকে। অতএব মানবতা ও গণতন্ত্রের স্বার্থে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এ ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। নৈতিক ও মতের ঐক্যই এ ক্ষেত্রে শক্তিমান প্রমাণিত হতে পারে।

সামরিক শাসন-নিয়ন্ত্রিত মিয়ানমার সরকারকে এই গণহত্যা থেকে ফেরানোর জন্য আন্তর্জাতিক নিন্দা ও নরম উদ্যোগই যথেষ্ট হতে পারে। এক্ষেত্রে মিয়ানমারের আশপাশের ও দূরের শক্তিশালী দেশগুলো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। সভ্যতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিশতে হলে যে গণহত্যা গ্রহণযোগ্য নয়, এই সত্য প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া রোহিঙ্গাদের দুর্দশার কথা কোনো কাজে লাগবে না। নিজ বাসভূমে ফিরে স্বাধীন নাগরিক হিসেবে নিজ জীবন পরিচালনার অধিকার লাভ ছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যার প্রকৃত পূর্ণ সমাধান নেই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App