×

মুক্তচিন্তা

নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে নৌ পর্যটন

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০১৭, ০৭:৪২ পিএম

আমাদের এই বাংলাদেশের সবুজ শ্যামল প্রাকৃতিক শোভা বিশ্বব্যাপী পর্যটকদের অনেক আগ্রহের বিষয়। ফলে আমাদের পর্যটন শিল্প অনেক সম্ভাবনাময়। কিন্তু প্রকৃতির উজাড় করা সৌন্দর্য ধারণ করেও পর্যটন শিল্পে ততটা অগ্রগতি হয়নি। এই শিল্পের যতটা এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল সেটা হয়নি। আবার যেভাবে এর বাজার তৈরির সুযোগ ছিল তাও হয়নি। অথচ এই একটি খাতই আমাদের অর্থনীতির চেহারা বদলে দিতে পারে। তবে আশার কথা গত এক দশকে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে ভিন্নমাত্রা যুক্ত হয়েছে। দিনে দিনে প্রসার লাভ করছে সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প। পর্যটন এমন একটি শিল্প যার মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব। কর্মসংস্থান হলে বেকারত্ব ঘুচে যায়, মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ে। আয় বাড়ার কারণে ভোগ ব্যয় বৃদ্ধি পায়, ফলে অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক কর্মকান্ডে নতুন গতির সঞ্চার হয়। অন্য যে কোনো শিল্পের তুলনায় পর্যটন শিল্প জিডিপিতে অনেক বেশি অবদান রাখতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশ পর্যটন শিল্পের ওপর ভর করে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।

নদীমাতৃক বাংলাদেশ রিভার ট্যুরিজম অর্থাৎ নৌ পর্যটনের দারুণ সম্ভাবনাময় একটি ক্ষেত্র। নদীবিধৌত বাংলাদেশের সমগ্র ভূখন্ড জুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল, হ্রদ, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-দীঘি আর জলাশয়। কোনো এক সময়ে এ দেশে ১ হাজার ৩৬০টি ছোট বড় নদ নদী, খাল-বিল ছিল। দিনে দিনে তা কমে বর্তমানে ৫৬০টিতে পৌঁছেছে। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নতুন মাত্রা যুক্ত করতে খাল কেটে নদী এবং সাগরের পানি শহরের ভেতর নিয়ে আসা হয়েছে। যা শহরের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সুগম করার পাশাপাশি পর্যটকদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের বড় বড় শহরগুলোতে এক সময় ছোট নদী কিংবা বড় বড় খাল বা শাখা নদীর অস্তিত্ব ছিল কিন্তু ভৌগোলিক কারণেই হোক অথবা বাড়তি জনসংখ্যার চাপে সেই সব নদ-নদী, খালের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়েছে। নদ-নদী, খাল, বিল, ঝিল, সব ভরাট করে শিল্প কলকারখানা, বহুতল ভবন, আবাসিক এলাকা, শপিং মল ইত্যাদি গড়ে তোলা হয়েছে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক চমৎকার হ্রদ, ছোট নদী যেগুলো নগর জীবনে দারুণ আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হিসেবে বিবেচিত হতে পারত।

পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন নদীবিধৌত ভূখন্ড নেই। এখনো আমাদের বাংলাদেশে যে পরিমাণ নদ-নদী, খাল-বিল-ঝিল হাওর-বাঁওড়, হ্রদ, পুকুর-দীঘি ইত্যাদি রয়েছে তাও কম নয়। যার কারণে এ দেশে রিভার ট্যুরিজম বা নৌ পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। রিভার ট্যুরিজম আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে সমৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠতে পারে। এটা আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভিন্নমাত্রা এনে দিতে পারে। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের জন্য যা সমৃদ্ধির নতুন সোপান সৃষ্টি করবে সন্দেহ নেই। এর মাধ্যমে বিদেশি পর্যটকদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে বাংলাদেশের নদী, হাওর, বিল, ঝিল এবং হ্রদ কেন্দ্রিক পর্যটন স্পটগুলো। কাপ্তাই, রাঙামাটি, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, ভৈরব, খুলনা, বাগেরহাট বরিশাল, ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালীতে নৌ পর্যটন শিল্প গড়ে তোলার যথেষ্ট সুযোগ এবং সম্ভাবনা রয়েছে। রিভার ট্যুরিজমের একটি বিরাট সুবিধা হলো, এখানে নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশের স্বাদ গ্রহণের চমৎকার সুযোগ রয়েছে, যা অন্যান্য পর্যটন উদ্যোগগুলোতে পাওয়া যায় না।

রিভার ট্যুরিজমের জন্য প্রয়োজন ছোট, বড়, মাঝারি আকারের নৌযানের সংখ্যা বৃদ্ধি। আরামদায়ক আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত জাহাজ বা স্টিমারে চড়ে পর্যটকরা সুন্দরবন, ভোলা, হাতিয়া, কাপ্তাই রাঙামাটি, বান্দরবান, ভৈরব, সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনার বিভিন্ন নদী কেন্দ্রিক পর্যটন কেন্দ্রে বেড়াতে গেলে সেগুলো বেশ জমজমাট হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই। ওই পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক কর্মকান্ডে নতুন জোয়ার সৃষ্টি হবে। এক সময়ে ঢাকার সদরঘাট থেকে নৌপথে চট্টগ্রাম যাতায়াতের সুযোগ ছিল। আশির দশকের শেষভাগে তা বন্ধ হয়ে যায়। যে কারণে এই অঞ্চলে রেলপথ ও সড়কপথে ক্রমাগত চাপ বাড়ছে। এমনিতে নৌপথে যাতায়াত খরচ কম। রিভার ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে এটাও একটি সুবিধাজনক ফ্যাক্টর হতে পারে। এখনো ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার, কাপ্তাই, রাঙামাটি, বান্দরবান, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, স্বন্দ্বীপ, হাতিয়া প্রভৃতি গন্তব্যে জাহাজ চলাচলের সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখা যেতে পারে। তেমন পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে নৌভ্রমণের জন্য কেটামেরাম ধরনের জাহাজের প্রচলন প্রয়োজন। অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি ওজনে হালকা জাহাজগুলোর গতিবেগ থাকে বেশি, দুটি জাহাজের মধ্যে পাশাপাশি ঘষা লাগলেও ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া প্রভৃতি দেশে এ ধরনের জাহাজ বেশি দেখা যায়। গতিবেগ বেশি হলেও আমাদের নদীপথে ঘণ্টায় ১২ থেকে ১৪ নটিক্যাল মাইল বেগে চলাচল করতে পারবে। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত ৬০০ যাত্রীর ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি জাহাজ তৈরিতে আনুমানিক ৭০ কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে।

প্রতিবেশী ভারতের কেরালা, জম্মু কাশ্মির কিংবা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, মারিশাস প্রভৃতি দেশে নৌ পর্যটন বেশ খাতি অর্জন করেছে। এসব দেশে রিভার ট্যুরিজমের জনপ্রিয়তা সহজেই চোখে পড়ে। শুধু নদী, হ্রদ, এবং সমুদ্র উপক‚লবর্তী এলাকাকে কেন্দ্র করে তারা তাদের পর্যটন শিল্পকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে। বৈচিত্র্যময় আকর্ষণীয় নৌ পর্যটন উদ্যোগগুলো দেশ-বিদেশের পর্যটকদের বার বার হাতছানি দিয়ে আহ্বান জানাচ্ছে, যাতে সাড়া দিয়ে লাখ লাখ পর্যটক সে সব দেশে বেড়াতে যাচ্ছে প্রতি বছর। কেরালা, জম্মুু, কাশ্মির কিংবা ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ার মতো আমাদের দেশেও রিভার ট্যুরিজমের চমৎকার আকর্ষণীয় স্পট রয়েছে রাঙামাটি, কাপ্তাই, বান্দরবান, খুলনা, বাগেরহাট সুনামগঞ্জ অঞ্চলে। এখন এগুলো অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে। অনাদরে অযত্নে অবহেলায় জীর্ণ-শীর্ণ অনাকর্ষণীয় অবস্থায় পড়ে আছে। সঠিক পরিচর্যা, পৃষ্ঠপোষকতা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে সম্ভাবনাময় নৌ পর্যটন ক্ষেত্রগুলোকে সবার আগ্রহ এবং মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলা যায়।

শুধু কক্সবাজার, রাঙামাটি, কাপ্তাই, বান্দরবান কিংবা সুন্দরবন নয় রিভার ট্যুরিজমের বিকাশের ফলে সমগ্র বাংলাদেশটাই হয়ে উঠতে পারে ভ্রমণের তীর্থস্থান। আমাদের ভাটি অঞ্চলে বড় বড় হাওর, বাওর, বিল, ঝিল, হ্রদগুলো বর্ষকালে সমুদ্রের রূপ ধারণ করে। মন ভরানো বর্ষার সেই অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য জাহাজ, স্টিমার, লঞ্চ, কিংবা স্পিডবোটে চড়ে পর্যটকরা বেরিয়ে পড়তে পারেন।

রাজধানী ঢাকা শহরকে বেষ্টন করে নৌপথ চালুর বিষয়ে অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ওয়াটার বাস চালু করা হয়েছে বুড়িগঙ্গা নদীতে। এখানেও রিভার ট্যুরিজমের বিরাট সুযোগ রয়েছে। ৪০০ বছর আগে ঢাকাকে ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডন শহরের সঙ্গে তুলনা করা হতো। লন্ডন টেমস নদীর তীরে অবস্থিত আর ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। ওই সময়ে ঢাকা নদীবিধৌত অঞ্চল ছিল। এখন সেই অবস্থা নেই আর। কিন্তু এখনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে রিভার ট্যুরিজমের নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ এবং চাঁদপুর অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। ১০০ বা ২০০ সিটের ওয়াটার বাস চালু করে তা দিয়ে ঢাকার আশপাশে নৌপথে ঘুরে বেড়ানোর ব্যবস্থা করা হলে মানুষ তা ভীষণভাবে উপভোগ করবে। পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। নদী কেন্দ্রিক পর্যটন উদ্যোগগুলোতে আমাদের অনেক নদী ড্রেজিং না করার কারণে ভরাট হয়ে আছে। যে কারণে ছোট বড় সব ধরনের লঞ্চ, স্টিমার, জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। এসব নদী ড্রেজিং করে নাব্য ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা যায়।

একটি বিষয় আমাদের সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে, পর্যটন একটি শিল্প। তাই এটিকে শিল্প হিসেবেই বিবেচনা করা প্রয়োজন। পর্যটন শিল্পের বিকাশে সরকারি এবং বেসরকারি উভয় দিক থেকে শক্তিশালী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রকৃতির লীলাভ‚মি হিসেবে পর্যটনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে দেশজুড়ে। রিভার ট্যুরিজমের নানা উদ্যোগ গ্রহণে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নৌ পর্যটনকে বিকশিত করতে নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে পর্যটন মন্ত্রণালয়, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে সমন্বিতভাবে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ জায়গায় এমনিতেই পর্যটনের দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে। এ খাতের অবকাঠামোগত উন্নয়নে যুগোপযোগী পরিকল্পনা এবং উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। রিভার ট্যুরিজম বা নৌ পর্যটনের বিকাশের মাধ্যমে আমাদের পর্যটন শিল্প দ্রুত আরো অনেকটা পথ এগিয়ে যেতে পারে। সরকার যদি এ খাতের উন্নয়নে একটি জোরালো উদ্যোগ নেয় এবং কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করে তাহলে রিভার ট্যুরিজম থেকে প্রচুর উপার্জন সম্ভব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App