×

মুক্তচিন্তা

অপরাধ নির্মূলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:০০ পিএম

পরকীয়া প্রেম, সম্পত্তির লোভ বা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যের একটি নেতিবাচক দিক, যা ব্যক্তির ইতিবাচক গুণাবলি দ্বারা দূর হওয়া সম্ভব। এই সম্ভাবনাকে নিশ্চিত করবেন দেশের সর্ব বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান সরকার এবং তা তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। সরকারকে সহায়তা করবেন জনগণ। এভাবেই নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে উঠবে, চর্চা হবে।

পারিবারিক দ্বন্দ্ব-কলহে হত্যাকান্ড প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা। যার মধ্যে পরকীয়া প্রেম, সম্পত্তির লোভ ইত্যাদি কারণগুলো উল্লেখযোগ্য। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কটি এমন ঘটনা ঘটল। অতীতেও ঘটেছে। তবে প্রবণতা বাড়ছে। সমাজ বিশেষজ্ঞরা, মনোবিশেষজ্ঞরা, রাজনীতি অঙ্গন ও সুশীল সমাজের কেউ কেউ অনেক কথা বলছেন পত্রপত্রিকায়, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়, সভা-সেমিনারে, সোশ্যাল মিডিয়ায়। এই বলা নানা ওজনে, আকার-আয়তনে এবং তা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে। ফলে বলাগুলো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের দিকে। কিন্তু বড় মিল ভাবের শেকড়ে। অর্থাৎ সবার বক্তব্য এক জায়গায় এসে মিলেমিশে গেছে। আর তা হলো- এসব পারিবারিক দ্বন্দ্ব-কলহের কারণ হিসেবে সবাই ঐকমত্য পোষণ করেছেন, করছেন যে, সামাজিক বা নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই এসব নৃশংস ঘটনা ঘটছে। এসব আলোচনা শুনলে মনে হয় বিশেষজ্ঞ আলোচকরা পাঠ্যপুস্তক খুলে বসেছেন। বিভিন্ন সূত্র বলছে, তাত্ত্বিক জ্ঞান আওড়াছেন। রীতিমতো সমাজ উদ্ধারে শব্দ, বাক্য প্রয়োগে প্রতিযোগিতা যেন। আর মিডিয়াও আছে টাটকা ইস্যু নিয়ে মুখরোচক পরিবেশনার নির্ঘুম ব্যস্ততায়। ভাব এমন, এ ধরনের ঘটনা অবসানে তারা মাত্রাতিরিক্ত সক্রিয়, চিন্তিত।

মানুষ ও বিজ্ঞানের অন্যতম তফাৎ হলো- বিজ্ঞান মানবীয় রূপ ধারণ করতে পারে না। কিন্তু মানুষ বিজ্ঞানের নানা রূপে নিজেকে আলোকিত করতে পারে। তত্ত্ব এখানেই সত্য এবং অনড়। আর যে সূত্র বা আইন মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে, সম্পূর্ণ সৃষ্টিকর্তার অধীনে, তা হলো প্রকৃতি। যার সঙ্গে মানুষের যুদ্ধ নয়, সমন্বয় করে চলতে হয়। বিজ্ঞান ও প্রকৃতি ছাড়া যেসব সূত্র বা তত্ত¡ মানবগোষ্ঠীর জীবনাচরণের তথা সামাজিক, তা কখনোই স্থির হতে পারে না, একটি জায়গায় থেমে থাকে না। কারণ, মানবজীবন পরিবেশ, বিজ্ঞান, প্রকৃতি দ্বারা পরিচালিত, নিয়ন্ত্রিত এবং তা ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। আর তাই নির্ধারিত সূত্র বা তত্ত্ব মোতাবেক মানবসমাজকে মূল্যায়ন করা, ভেবে কথা বলা, সিদ্ধান্ত নেয়া এক ধরনের বোকামি। যেটা হয়, বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠী সবর্দা সূত্র বা তত্ত¡ দিয়ে কথা বলেন। ফলে কথার কথা অনেক হয় কিন্তু বাস্তবভিত্তিক হয় না। নৈতিক বা সামাজিক অবক্ষয় শব্দগুলো উল্লিখিত ক্ষেত্রে বহুল উচ্চারিত। কেন এই অবক্ষয় তা বিশ্লেষণের আগে নৈতিকতা কী তা বলা জরুরি। নৈতিকতা একটি বোধ, যা মানবজীবনকে পরিপূর্ণতা দেয়, সুশৃঙ্খল রাখে, আনন্দিত করে রাখে, নিরাপত্তা দেয় এবং যার উৎপত্তিস্থল হলো শিক্ষা। এটা আমরা কমবেশি সবাই জানি। এই শিক্ষা পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক। একটি পরিবারের মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সুস্থতা একজন শিশুকে সুস্থভাবে বেড়ে উঠবার শক্তির জোগান দেয়। বেড়ে উঠবার পথকে করে নিষ্কণ্টক, প্রশস্ত। আমাদের দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার বৈষম্যের কারণে অধিকাংশ পরিবারে থাকে অস্থিরতা বিরাজমান। ফলে সেসব পরিবারে শিশুরা মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বেড়ে ওঠে। এর সঙ্গে যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপযুক্ত শিক্ষার অভাব যুক্ত হয়, তাহলে সর্বনাশা একটি পরিণতি ছাড়া কোনো কিছুই আর দৃশ্যমান হয়ে ওঠে না। যে কারিকুলাম, বিষয়বস্তু শেখানো হচ্ছে, তা কোনোভাবেই নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত হওয়ার জন্য উপযুক্ত নয় এবং যে কৌশল বা পদ্ধতি-প্রক্রিয়ায় শেখানো হচ্ছে তা নেহায়েত কার্গোশিপে মালামাল তোলা এবং গন্তব্যে পৌঁছানোর মতো। এখানে রাজনৈতিক আগ্রাসন শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতির পবিত্রতা নষ্ট করে। ফলে সমাজের আগাছাদের অনেকেই শিক্ষক হিসেবে মর্যাদা পেয়ে যান, শিক্ষকতার ব্যবসায়ে লিপ্ত হন। এরা জাত শিক্ষক না হওয়ায় এদের দ্বারা অনৈতিক কর্মকান্ডও সংঘটিত হয়। বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে এরা আবার ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। ফলে পরিণত বয়সে নৈতিক শিক্ষার অভাবে অনেকেই অপরাধী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

একটি দেশের সর্ববৃহৎ, ক্ষমতাসম্পন্ন, শক্তিধর প্রতিষ্ঠানটির নাম সরকার। সরকার যদি রাজনৈতিক হন, তাহলে তার যেমন একটি ইতিবাচক দিক থাকে, তেমনি থাকে একটি নেতিবাচক দিক। ইতিবাচক দিক হলো, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠিত হয়। এখানে গণতন্ত্রচর্চার সুযোগ থাকে। সবার সাংবিধানিক অধিকার, মানবাধিকার সুরক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, অঙ্গীকার থাকে। আর নেতিবাচক দিকটি হলো- রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতা এবং যার ভয়াবহতার আঘাত পড়ে গোটা জাতির ওপর এবং তা নির্মমভাবে। রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতার উৎপত্তি হয় আবার ক্ষমতালিপ্সা থেকে। ফলে ক্ষমতাকেন্দ্রিকতা রাজনৈতিক আদর্শ থেকে থেকে ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে পৃথক রাখে। অর্থাৎ নেতাকর্মীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আদর্শচ্যুত হয়ে পড়েন এবং দলের স্বার্থ রক্ষা করেন। ফলে জাতির স্বার্থ গৌণ হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক সরকারের ইতিবাচক দিকটি যদি তার নেতিবাচক দিককে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, শাসন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে রাজনৈতিক সরকারের সুফল ভোগ করা জাতির পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না, উঠবে না। বিষয়টি অনেকটা মানুষের মস্তিষ্কের ইগো, সুপার-ইগো ও ইদের মতো। ইগো ও সুপার-ইগো (অহংবোধ) যদি ইদকে (ব্যক্তির কামনা-বাসনা) নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয় তাহলে মানুষটি বিকৃতি নিয়ে বিচরণ করবে।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতা বা সদিচ্ছার অভাবই বিভিন্ন সামাজিক, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্বশীল ও দায়বদ্ধ করার, সৎ রাখার ক্ষেত্রে বড় একটি অন্তরায়। রাজনৈতিক দাপট অনেক ক্ষেত্রে আইনকে নিয়ন্ত্রণ করে বিধায় আইনসম্মত জীবনাচরণে ব্যক্তি অভ্যস্ত হতে ব্যর্থ হয়। এই ফাঁক সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে যায়, ব্যক্তি মাত্রই এই সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। ফলে জীবনাচরণের শৃঙ্খলা লঙ্ঘিত হয়, ব্যক্তি অপরাধ করে। তা যে কোনো ধরনের অপরাধ হোক না কেন।

শাস্তির ভয় না থাকা মানেই হলো বিচারহীনতা। বিচারহীনতার সংস্কৃতি যে কোনো ধরনের অপরাধের জনক। পরকীয়া প্রেম, সম্পত্তির লোভ বা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যের একটি নেতিবাচক দিক, যা ব্যক্তির ইতিবাচক গুণাবলি দ্বারা দূর হওয়া সম্ভব। এই সম্ভাবনাকে নিশ্চিত করবেন দেশের সর্ব বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান সরকার এবং তা তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। সরকারকে সহায়তা করবেন জনগণ। এভাবেই নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে উঠবে, চর্চা হবে।

মূলকথা নৈতিক মূল্যবোধ ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র বহির্ভূত কোনো বিষয় নয়। এটিকে গড়ে তুলতে, দৃশ্যমান করতে সবার মধ্যে, সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্বচ্ছ সমন্বয় থাকা বাঞ্ছনীয় এবং তা একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্যকে স্থির করে। যে কোনো ধরনের মিথ্যাচার অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়, এটি পরিহার করা জরুরি। আবারো বলছি, শাসন ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের হাত থেকে রক্ষা করা না গেলে নৈতিক বোধ জাগ্রত হবে না। অবক্ষয় স্থায়ী রূপ লাভ করবে এবং তা রাজনৈতিক দল, দেশ, জাতি কারো জন্য কল্যাণকর হবে না, অস্তিত্ব রক্ষা করবে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App