×

মুক্তচিন্তা

রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে জাতিসংঘের দায়িত্ব ও কর্তব্য

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:২৯ পিএম

বিশ্ব সংকট নিরসনে আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থাগুলোর দায়িত্ব ও কর্তব্যের পরিধি আরো বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন। আজ রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে দুটি শক্তিশালী দেশের স্বার্থের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এই সংকট সমাধানের ব্যাপারে তারা যদি সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত না করে, তাহলে জাতিসংঘের পক্ষে সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।

সময়ের প্রয়োজনে

জাতিসংঘ প্রথম যখন গঠন করা হয় তখন তার মূল লক্ষ্য ছিল বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত এই বিশ্ব সংস্থাটি বিশ্ব শান্তি সংরক্ষণে অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এটা বলা ঠিক হবে না যে, এই সংস্থাটি তার দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। তবে সব সংকটের সমাধান এই সংস্থা করতে পেরেছে এরূপ দাবি করা ঠিক হবে না। বিশ্বের অনেক সংকট আছে যেখানে জাতিসংঘ দ্রুত হস্তক্ষেপ না করলে রক্তপাতের মাত্রা আরো বেশি হতে পারত। জাতিসংঘের উপস্থিতির কারণে তা থেকে সেখানকার জনগণ রক্ষা পেয়েছে। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘাত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তো লেগেই আছে। এক রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী অত্যন্ত অযৌক্তিকভাবে আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে আরেক রাষ্ট্রে ঢুকে পড়েছে। জোর দখল করে অন্য রাষ্ট্রের ভূমি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের তাড়িয়ে দিয়ে নিজেরা বসতি স্থাপন করছে। বিশ্ব নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে বৃহত্তম যুদ্ধ চলাকালীন পরাশক্তির সেনাবাহিনী তথাকথিত বন্ধু রাষ্ট্রের ভেতর সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে অবস্থান নিয়েছিল, তা কোথাও কোথাও এখনো বলবৎ রয়েছে। চলছে সীমানা সংঘাত, নদী ও সমুদ্রের ভাগাভাগিতে সংঘাত, ধর্মীয় কারণে সংঘাত, বিশ্বের অপেক্ষাকৃত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদশালী অবস্থানগুলোকে নিজেদের দখলে রাখার চেষ্টা; যুদ্ধাকালে কৌশলগত কারণে বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে প্রভাব রাখাজনিত সংঘাত। আর অর্থনৈতিক কারণে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘাত নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গা সংকটের প্রকৃতি কিন্তু একটু ভিন্ন ধরনের।

মিয়ানমার এমন একটা রাষ্ট্র যেখানে ১৩৫-এর ওপর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের (ভাষা, ধর্ম ও বর্ণের) লোক বসবাস করে। তাদের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় মিয়ানমার সরকারের আনুগত্য স্বীকার করতে রাজি নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সংঘাত তাই অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল বিভিন্ন গোষ্ঠীর লোকরা সুদীর্ঘ দিন সংগ্রামের পর মিয়ানমার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কারণে আপস করেছে। রোহিঙ্গারা এমন এক সম্প্রদায় যারা অতীতে কোনো কোনো সময় সংগ্রাম করে প্রায় স্বাধীনভাবে বসবাস করার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাস্তবিকভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পেরে ওঠেনি। যুদ্ধ-বিগ্রহের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার রাখাইন এলাকায় তাদের আধিপত্য বজায় রেখেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের আনুগত্য মেনে নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করায় তাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সব সময় নিপীড়ন ও নির্যাতন চালিয়ে আসছে। এক সময় মিয়ানমার সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। নাগরিক অধিকার বলতে যা বোঝায় তাও তারা বেশ কিছুটা ভোগ করত। বর্তমান অবস্থাটা খুবই খারাপ। ব্যক্তিগত, নাগরিক, মানবিক অধিকার কোনো কিছুই তাদের নেই। এমনকি নিজের দেশে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হলে সেনাবাহিনীর অনুমোদন নিতে হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জরুরি বিষয়ে সেবা গ্রহণে তাদের কোনো সুযোগই ছিল না। কেন্দ্রীয় সরকার তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। এবার রোহিঙ্গাদের ওপর চরম বর্বর নির্যাতন চালানো হয়েছে। একটা মূল লক্ষ্য সামনে রেখেই এমন পৈশাচিক আক্রমণ তাদের ওপর চালানো হয়েছে। বাড়িঘর পুড়ে ছারখার করে দেয়া হয়েছে। হাজার হাজার মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। আবালবৃদ্ধবনিতাদের নির্বিচারে গুলি করা হয়েছে। এমন নির্যাতন করা হয়েছে যেন তারা পরবর্তী সময়ে আর নিজস্ব ভিটামাটিতে পৌঁছাতে না পারে। সে কারণে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ রোহিঙ্গা পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশে যেতে বাধ্য হয়েছে।

জাতিসংঘ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেনি। শোনা যায় মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর এরূপ নির্যাতন চালাবে যে তা পূর্ব পরিকল্পিত ছিল এবং জাতিসংঘের কোনো কোনো কর্মকর্তা জানতে পেরেও বিষয়টি গোপন রেখেছেন। সংস্থাকে তা জানতে দেননি। এরূপটা যদি হয়ে থাকে, তবে তা যে ষড়যন্ত্রমূলক তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। পরে অবশ্য জাতিসংঘ তাদের ওইসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিছু অ্যাকশনও নিয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিষয়টি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উত্থাপন করেছেন। নিরাপত্তা পরিষদ বিষয়টি নিয়ে দুবার আলোচনায় বসেছে কিন্তু সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব পাস করিয়ে নিয়ে তা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। ওইরূপটা করা হলে চীন ও রাশিয়া উভয়েই ভেটো প্রয়োগ করবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। তাই দুবারই জাতিসংঘ থেকে মিয়ানমার সরকারের ওপর অনুরোধ জানানো হয়েছে তাদের নিপীড়ন-নির্যাতন বন্ধ করতে এবং রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যবস্থা করতে। অনেকের ধারণা, এই ধরনের পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়।

প্রায় তিন মাস কেটে গেল। মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো যে, রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া হবে। একজন মিয়ানমার মন্ত্রীও বাংলাদেশে এসে এরূপ আশ্বাস দিলেন। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমারে গিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করলেন। তার পরও বেশ কিছু সময় উত্তীর্ণ হলো কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। যেভাবে মিয়ানমার সরকার যাচাই-বাছাই করে প্রতিদিন তিনশ রোহিঙ্গা ফেরত নিতে চায় তাতে করে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে যে সময় অতিবাহিত হবে, সেই সময়কালে রোহিঙ্গা সংকট এমন মোড় নিতে পারে যে তা শুধু দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াই নয়, গোটা বিশ্বের জন্য বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যে সংকট মাত্র ১৫ দিনে সৃষ্ট গোটা বিশ্বে এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা তার সমাধান যদি এক যুগ ধরে করতে হয় বা তার চেয়েও বেশি সময় লাগে, তাহলে বিশ্ব সংস্থার ভূমিকা কী তা নিয়ে তো প্রশ্ন উঠতেই পারে।

এ কথা ঠিক জাতিসংঘের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেয়ার যে অধিকার ভোগ করে থাকে তা পৃথিবীর অনেক অঞ্চলের বিপুল জনগোষ্ঠীর স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম করেও কোনো কোনো জনগোষ্ঠী তাদের যুক্তিসঙ্গত দাবিতে সফল হতে পারেননি। তাই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অধিকাংশ সদস্য দেশগুলোর ভোটে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়ে থাকে, নিরাপত্তা পরিষদের মাত্র পাঁচটা দেশের সে সিদ্ধান্ত অকার্যকর করা উচিত নয়। পরাশক্তিগুলো তাদের স্বার্থে রোহিঙ্গা নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী জঘন্য নৃশংসতার পক্ষে অবস্থান নেয়, তাহলে বিশ্ব মানবতা পর্যুদস্ত হতে বাধ্য। বিশ্বের বৃহৎ শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর ভোটের অধিকার কোনো অংশে একটা ক্ষুদ্র অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রের ভোটের গুরুত্ব থেকে বেশি গুরুত্বশীল হবে বলে বিবেচনা করা সমুচিত নয়। জাতিসংঘের প্রত্যেক রাষ্ট্রের সমান অধিকার থাকা উচিত। পরাশক্তিগুলোর স্বার্থ উদ্ধারে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন সংকটকালে যদি ন্যায়-নীতি ও সততার বিরুদ্ধে অবস্থান করা হয়, তাহলে বিশ্ব সংস্থা থেকে লাভ কি?

বিশ্ব সংকট নিরসনে তাই আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থাগুলোর দায়িত্ব ও কর্তব্যের পরিধি আরো বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন। আঞ্চলিক সংকটগুলোর আঞ্চলিক সমাধানের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের উচিত আরো বেশি করে ক্ষমতা প্রদান। আজ রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে দুটি শক্তিশালী দেশের স্বার্থের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এই সংকট সমাধানের ব্যাপারে তারা যদি সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত না করে, তাহলে জাতিসংঘের পক্ষে সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যেসব দেশ সদস্য আছে, যথা- বিসটেক, (আশিয়ান) ও সার্ক দেশগুলো সঠিকভাবে তৎপর হলে রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব। এই তিনটি অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থার সদস্য দেশগুলো আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে সফলতা লাভ করে বিশ্বের এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান অত্যন্ত জরুরি। তাই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে এই আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থাগুলোই পারে রোহিঙ্গা সংকটের প্রকৃত সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে। আর জাতিসংঘ যদি এরূপ একটা ইস্যুতে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়, তাহলে এই বিশ্ব সংস্থার ওপর থেকে অচিরেই মানুষ আস্থাহীন হয়ে পড়বে।

ডা. এস এ মালেক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App