×

মুক্তচিন্তা

ধর্মানুভূতির আগুনে পুড়ছে সংখ্যালঘুর কপাল

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:০১ পিএম

ফটো সাংবাদিক মইনুল হোসেনের তোলা এক বৃদ্ধার আহাজারির ছবিটি হৃদয়বিদারক। পেছনে দাউ দাউ করে বাড়িঘর পুড়ছে, বৃদ্ধা মাথায় হাত দিয়ে বিলাপ করছেন? ফেসবুকে একজন লিখেছেন, ‘মা, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ হেরে গেছে। নাসিরনগর, রামু, সাঁথিয়া বলে দিচ্ছে এ দেশ তোমার নয়’? কেন বারবার ধর্মানুভ‚তির অজুহাতে সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণ হচ্ছে...

নাসিরনগর ঘটনার বর্ষপূর্তি হলো রংপুরে। ঘটনা একই, সেই ফেসবুক, ধর্মীয় অনুভ‚তিতে আঘাত, হাজারো তৌহিদি জনতার হিন্দু বাড়িঘর আক্রমণ, জ্বালাও-পোড়াও, লুট, শ্লীলতাহানি এবং ভিকটিমদের আহাজারি। তবে এবার পুলিশের গুলিতে একজন মরেছে। হয়তো পুলিশ হস্তক্ষেপ না করলে পরিস্থিতি আরো মারাত্মক হতে পারত। ঘটনা ঘটেছে শুক্রবার, জুমার পর। দেখতে হবে মসজিদ থেকে কেউ উসকানি দিয়েছেন কিনা? সাম্প্রদায়িক হামলার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ। ভুয়া ধর্মীয় অনুভ‚তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা ইস্যুতে পুরো বাংলাদেশ এগিয়ে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া ছুটে গিয়েছেন। এবার দেখার পালা রংপুরে সবাই ছুটে যান কিনা? দেশবাসী এই জ্বালাও-পোড়াওয়ের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে কিনা? না পড়লে বুঝতে হবে, ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’? এটাও বোঝা হয়ে যাবে, রামু, নাসিরনগর বা রংপুরই আজকের বাংলাদেশ! কিছু ধর্মান্ধ উগ্রপন্থীর অনুভ‚তির দৌরাত্ম্যে অন্যরা দেশান্তরী হচ্ছে। হনুমানের লেজের আগুনে লঙ্কা পুড়েছিল, বাংলাদেশে ধর্মানুভ‚তির আগুনে পুড়ছে সংখ্যালঘুর কপাল।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু একটি অসহায় নাম। দেশ স্বাধীন, সংখ্যালঘুরা স্বাধীন নন। ধর্মীয় অনুভ‚তিতে আঘাত শুধু একটা ধর্মাবলম্বীদের লাগে, অন্যদের তা লাগতে নেই? মিডিয়ায় রংপুরের সংবাদ ও ছবিতে সয়লাব। ফটো সাংবাদিক মইনুল হোসেনের তোলা এক বৃদ্ধার আহাজারির ছবিটি হৃদয়বিদারক। পেছনে দাউ দাউ করে বাড়িঘর পুড়ছে, বৃদ্ধা মাথায় হাত দিয়ে বিলাপ করছেন? ফেসবুকে একজন লিখেছেন, ‘মা, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ হেরে গেছে। নাসিরনগর, রামু, সাঁথিয়া বলে দিচ্ছে এ দেশ তোমার নয়’? কেন বারবার ধর্মানুভ‚তির অজুহাতে সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণ হচ্ছে, এ প্রশ্ন অবান্তর। কুমিল্লায় জনৈক হাবিবুর রহমান পবিত্র কুরআনের অবমাননা করেছিল, তার বাড়িঘর কেন পোড়েনি, সেটাও বিবেচ্য নয়? প্রশ্ন হলো, আর কত ঘটনা ঘটলে, দেশবাসী বুঝবেন যে, ধর্মকে ব্যবহার করে এটি একটি লাভজনক ব্যবসা এবং একটি সম্প্রদায়কে দেশ থেকে বিতাড়নের পাঁয়তারা? বব ডিলানের সেই বিখ্যাত গানের অনুকরণে বলা যায়, ‘আর কত বাড়িঘর পুড়লে আমরা বুঝব যে, সত্যিই হিন্দু কপাল পুড়ছে’?

রংপুরের ঘটনার দায় অবশ্যই প্রশাসনের। কিন্তু শুধু সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে না দিয়ে রাজনীতিকদের এগিয়ে আসতে হবে। ধর্মানুভ‚তি নতুন কোনো ব্যাধি নয়, এটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে নতুন আঙ্গিকে। সেটা শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত থেকে উত্তম, রসরাজ বা এমনতর আরো অনেক দৃষ্টান্ত আছে। কোনোটার সত্যতাই মেলেনি। রংপুরেও মিলবে না, তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যতই তোড়জোড় করুন না কেন? বাংলাদেশ আইটি ক্ষেত্রে অনেক এগিয়েছে। টিটু রায়, অর্থাৎ যে আইডি প্রোফাইল থেকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ উঠেছে সেটা যে ভুয়া তা বের করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়? আমাদের স্মার্ট তরুণরা ইতোমধ্যে সামাজিক মাধ্যমে সেটা উদঘাটন করে ফেলেছেন। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভুলে গেছেন, ওনার আমলে এমত অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে, কোনোটারই বিচার হয়নি, পুলিশ হয়তো চার্জশিটই দেয়নি। নাসিরনগরে অভিযুক্তরা সবাই জামিনে মুক্ত। রামু, নন্দীরহাট, অভয়নগর কোনোটারই বিচার হয়নি। এমনকি ২০০১-এর অত্যাচারেরও বিচার হয়নি! ছেলেবেলায় দোকানে লেখা দেখতাম, ‘বাকি চাহিয়া লজ্জা দেবেন না’? এখন একইভাবে বলা যায়, ‘সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচার চাহিয়া লজ্জা দেবেন না’?

রংপুরের ঘটনার জের নাকি চট্টগ্রামেও পড়েছে। সেখানে ঐতিহ্যবাহী ‘সাধুর মিষ্টির দোকান’ শুক্রবার লুটপাট হয়েছে, কর্মচারীদের মারপিট করা হয়েছে, এমনকি দোকানের সাইনবোর্ড পর্যন্ত পাল্টে গেছে। প্রত্যক্ষদর্শী জানাচ্ছেন, কোতোয়ালি থানার পঞ্চাশ গজ দূরে হিন্দুবাবুর দোকানের সাইনবোর্ড, চেয়ার-টেবিল দুমড়ে-মুচড়ে বাইরে ফেলে দেয়া হয়েছে। দোকানে রাজভোগ, রসমালাই, মিষ্টি গড়াগড়ি খাচ্ছে থানার সামনের রাস্তায়। মালিক-কর্মচারীদের বেধড়ক মার দিয়ে টেনেহিঁচড়ে বের করে সেখানে লাগানো হয়েছে তিনটি বড় বড় তালা। সামনে থানা থাকলেও এতে পুলিশের অনুভ‚তিতে আঘাত লাগার কোনো খবর পাওয়া যায়নি? তবে ঢাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, টিটু রায় যাতে ভারতে পালাতে না পারে তাই সীমান্তে রেড-এলার্ট জারি করা হয়েছে। শাবাশ। এক সামান্য টিটো রায়কে ধরার জন্য এত তোড়জোড়, অথচ যে হাজারো জনতা মিছিল করে হিন্দুপল্লী আক্রমণ করল, তাদের বিরুদ্ধে তিনি কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন তা কিন্তু আমরা জানলাম না?

রংপুরে এই ঘটনা ঘটল ১০ নভেম্বর ২০১৭। অথচ এই দিনে গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন নূর হোসেন। নূর হোসেন উদাম গায়ে পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর। পুলিশের গুলিতে ২৬ বছরের তরুণ নূর হোসেন সেদিন নিহত হন। তখন যে সাংবাদিকরা সেখানে ছিলেন তাদের মতে, ‘ওই লেখার জন্য তাকে টার্গেট করে হত্যা করা হয়’। রওশন এরশাদ অবশ্য বলেছেন, ‘এরশাদ নন, আন্দোলনকারীরাই নূর হোসেনকে হত্যা করেছে’। তিনি কারণও বলেছেন। তার মতে, লাশ হলে আন্দোলন জমে? নূর হোসেন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্মরণীয় শহীদ। কিন্তু যে গণতন্ত্রের জন্য নূর হোসেন প্রাণ দিয়েছেন সেই গণতন্ত্র এখনো বাংলাদেশে ‘সোনার হরিণ’। গণতন্ত্র থাকলে এবং সব নাগরিকের সমান অধিকার থাকলে দেশে বারবার নাসিরনগর-রংপুর ঘটনা ঘটতে পারে না। বিচারহীনতা এবং প্রশাসনিক উদাসীনতা এ জন্য বহুলাংশে দায়ী। এ ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে বলছে, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে আর যাই হোক, বড়াই করা চলে না?

নিউইয়র্ক, ১০ নভেম্বর ২০১৭ শিতাংশু গুহ : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App