×

মুক্তচিন্তা

সৌদি আরবে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র : নেপথ্যে তেলের রাজনীতি!

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০১৭, ০৭:৩৩ পিএম

সৌদি আরবের কট্টরপন্থী প্রবীণ আর ধনকুবের অভিজাত গোষ্ঠীর পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। ফলত তারাও এখন বেপরোয়া। গুটি চালার এখনই শ্রেষ্ঠ সময়! যদি তারা ব্যর্থ হয় এ মিশনে তবে অনিবার্য গৃহযুদ্ধে নিপতিত হবে সৌদি আরব।

মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রায় একশ বছর দেশ শাসন করে আসার পর সৌদি আরবের ‘পরম পাকা’ প্রবীণরা হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলেন, ৩২ বছর বয়সী এক ‘সেদিনের ছোকরার’ নির্দেশে আজকাল তাদের উঠ-বস করতে হচ্ছে রীতিমতো। ছোকরার নাম মোহাম্মদ বিন সালমান। বাদশাহ সালমানের তিনি কনিষ্ঠ পুত্র, রাজ্যের ভাবী বাদশাহ। বিশ্বের শীর্ষ তেল উৎপাদক দেশটির মহাগুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব কবজা করেছেন আগেই। সৌদি অর্থনীতির পুনর্বিন্যাস নিয়েও উদ্ভাবনী পরিকল্পনা রয়েছে তার। তারই সিদ্ধান্তে প্রবীণ গোষ্ঠীর উষ্মা ঘটিয়ে রাজপথে গাড়ি চালানোর বিতর্কিত অনুমোদনটি পেয়ে গেছে অসূর্যস্পর্শা সৌদি নারীরা। এ ধারাবাহিকতাতেই গত সপ্তাহে আবারো তৎপর হয়েছেন যুবরাজ। দুর্নীতি দমনের নামে ঝটিকা অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করে ফেলেছেন দেশের শীর্ষ ক্ষমতাধর একঝাঁক মন্ত্রী আর নিজের জ্ঞাতিতুতো রাজপুত্রদের। এসব ধরপাকড়ের একদিন আগে সরকারি বার্তায় হঠাৎ ঘোষণা দেয়া হল- আরব মহল্লার সৌদি শত্রু  ইরানবান্ধব হুতি উপজাতিরা নাকি রিয়াদ লক্ষ্য করে একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। সৌদির দাবি- ইরান থেকেই নিক্ষিপ্ত হয়েছে এ ক্ষেপণাস্ত্র এবং এটি অবশ্যই যুদ্ধ ঘোষণার শামিল।

মধ্যপ্রাচ্যে অপরিবর্তনীয় প্রাচীনতার এক মূর্তপ্রতীক সৌদি আরব। দীর্ঘকাল ধরেই তারা অঞ্চলের অটল কেন্দ্রবিন্দু। যদিও ২০০৮ সাল থেকে বদলাতে আরম্ভ করেছে চিত্রটি। রাশিয়ার মতো সৌদি আরবও অর্থনীতি সামাল দিতে দুঃসময়ে ভর করেছে তেলের ওপর। ওই সময়কার আর্থিক সংকট বিশ্বকে এমন একপর্যায়ে ঠেলে দিয়েছিল যেখানে কারো জিডিপি মাত্র ২ শতাংশ বাড়লেও ধরা হচ্ছিল প্রবৃদ্ধির বিস্ফোরণ ঘটেছে তার। এ পর্যায়ের সংকটের ফলে সীমিত থাকতে বাধ্য হলো বৈশ্বিক শিল্প উৎপাদন এবং বেতালে পড়ে গেল তেলের দাম। তেল রপ্তানিকারক নতুন দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আবির্ভাবের দরুণ তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার থেকে বাধ্য হলো আরো নিচে নেমে যেতে। বিভিন্ন অজুহাতে সৌদি আরব এবং রাশিয়াসহ ওপেকভুক্ত দেশগুলোর সার্বক্ষণিক চিন্তা থাকে, কীভাবে তেলের দাম আরো একটু বাড়িয়ে তোলা যায়। সমস্যাটি তৈরি হয় তৃতীয় পক্ষ নিয়ে। যখনই দেখা যায় উৎপাদন কমিয়ে তেলের দাম বাড়ানোর নতুন পাঁয়তারা কষছে সৌদি আরব, তখনই দেখা যায় ‘হাভাতে’ কোনো তেল-উৎপাদক ঠিকই উঠে এসেছে শূন্য জায়গাটি আগ বাড়িয়ে পূরণের জন্য। বোধগম্য কারণেই তা এক অসহনীয় পরিস্থিতি সৌদি আরবের জন্য।

সৌদি এলো বিশ্বে: ব্রিটিশ নির্দেশনায় দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে সৌদি আরবের আবির্ভাব ঘটে বিশ্বে। ১৯২০ সালে হাশেমাইট উপজাতিকে যুদ্ধে পরাজিত করে নিজেদের তালুকের সীমা বাড়িয়ে নেয় সৌদরা। এর কিছুদিন পরই ব্রিটিশরাজের অকুণ্ঠ আশীর্বাদবর্ষণ ঘটে তাদের ওপর। কিন্তু সর্বময় ক্ষমতা হাতে এলেও সীমাহীন উচ্চাকাক্সক্ষা, চাপা ক্ষোভ আর অবিরাম ষড়যন্ত্রের জাল থেকে আজ পর্যন্ত মুক্ত হতে পারেনি সৌদরা। নরম্যান রকওয়েলের পেইন্টিংয়ের চেয়ে কর্লিওনির সঙ্গেই বরং সহজে তুলনা চলতে পারে সৌদি রাজপরিবারের।

ফেলো কড়ি, বুঝেশুনে মাখো তেল: নিজেদের শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য কিছুই করতে হয় না সৌদি আরবের রাজপরিবারকে, কেবল সমাজভুক্ত বিশেষ কিছু গোষ্ঠীর মাঝে কিছু কিছু টাকা বিলি করতে হয় মাঝে মধ্যে। সৌদি মসনদে থাকার জন্য টাকাই মূল অস্ত্র। বুদ্ধি খাটিয়ে টাকা ছড়াতে পারলেই চলবে। এর বেশিরভাগ অবশ্যই যেতে হবে রাজপুত্রদের হাতে, তবে অন্য প্রভাবশালীদেরও উপেক্ষা করা যাবে না। ফলে হিংসা-বিদ্বেষ বরাবর বর্তমান থাকলেও তার উচ্চকিত প্রকাশ ঘটেনি খুব একটা। এসব টাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবিদার দেশটিতে রক্ষণশীল ইসলামি ধারার কট্টর অনুসারী ওয়াহাবি গোষ্ঠী।

মক্কা এবং মদিনা জয় করার পর সৌদরা ইসলামের পবিত্র দুই নগরীর হেফাজতকারী হিসেবে ঘোষণা দিল নিজেদের। এটি ছিল এক বিশেষ সম্মান, এক পরম দায়িত্ব এবং রাজনৈতিক বোঝাও বটে। ওয়াহাবিদের টাকার ভাগ দিতেই হচ্ছিল সৌদদের এবং তা দিতে গিয়ে একপর্যায়ে ওয়াহাবি ফাঁদে আটকে গেল তারা নিজেরাও। লন্ডন, প্যারিস আর ইউরোপের অন্য শহরে কীভাবে বিলাসবহুল প্রমোদের জীবন কাটাতে হয় সেটা ভালোই জানা আছে রাজপরিবারের। তবে কখনই তাদের কেউ কট্টর ইসলামি পন্থাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখার কথা ভাবেনি কখনো। যদিও এ নিয়ে ভাবনা করার মতো লোকের অভাব ছিল না রাজ্যের ভিতরে এবং এটাই এক সময় হয়ে দাঁড়ালো সৌদি আরবের আপাত ঐক্যের মাঝে দৃশ্যমান ফাটলরেখা, এতোদিন যা চেপে রাখা হয়েছিল টাকার পাহাড়ের নিচে। কিন্তু শিল্প উৎপাদনে না গিয়ে কেবল বসে বসে খেলে যা হয়, একপর্যায়ে টান পড়ল রাজকোষের টাকার থলেতেও। রাজপরিবারের অনেকেই ঝুঁকে পড়ল তেলের দিকে। কিন্তু বিশ্ব বাজারে তখন পর্যাপ্ত তেল। বিপদে পড়লেও সৌদির বিপদ দেখার মতো সময় তখন নেই মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। তাছাড়া সৌদি রাজপরিবারও, বিশেষত এর ওয়াহাবি অংশ, ততদিনে মদদ দিতে শুরু করেছে বিশ্বব্যাপী জেহাদি গোষ্ঠীগুলোকে। তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় উপদ্বীপের চালিকাশক্তির ভ‚মিকা থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হলো সৌদরা। অস্থিতিশীলতা মাথাচাড়া দিল চিরকাল সৌদি হুকুমাতের নিচে বসবাস করে আসা প্রতিবেশী ইয়েমেনেও। ইরাকে প্রথমে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিয়ে, পরবর্তীতে হারতে শুরু করল সৌদিপুষ্ট সুন্নিরা।

তেলের পড়তি দামের কারণে শুরু হলো বিকল্প পথ খোঁজাখুঁজি। সৌদির টিকে থাকতে চাই আয়ের বাড়তি কোনো পথ। এ পর্যায়ে বাদশাহ সালমান তার গোটা রাজ্যের চাবিকাঠি তুলে দিলেন পুত্র মোহম্মদ বিন সালমানের হাতে। মোহাম্মদ যখন উপ-যুবরাজ তখনই সৌদি আরবের উন্নয়নে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা, রূপকল্প-২০৩০ ঘোষণা করলেন তিনি। সৌদি আরবকে তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে একটি প্রথম সারির শিল্প উৎপাদক দেশ হিসেবে উঠে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু তা করতে হলে দুটো বিষয় প্রথমেই নিশ্চিত করতে হবে তাকে। প্রথমত, রাজপরিবারের সদস্য এবং অন্যান্য অর্থপতিদের নিজেদের স্বার্থের পাশাপাশি সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক স্বার্থকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। বোঝা গেল, দেশকে তুলে আনতে হলে দেশের ভিতরে এবং বাইরে, দুই জায়গা থেকেই টাকা বের করে আনতে হবে যুবরাজকে। এ পরিকল্পনারই আংশিক বাস্তবায়ন, রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি সৌদি আরামকোর অংশভাগ বিক্রি করে দেয়া। এ থেকে পরিষ্কার যে সত্যটি উঠে আসছে তা হচ্ছে, বিশ্বে আসলেই ফুরিয়ে এসেছে তেলকুবেরের রাজত্বের দিন।

দ্বিতীয়ত, সৌদি সংস্কৃতিতে ওয়াহাবি নেতাদের প্রভাববলয় ছিন্নভিন্ন করে দিতে হবে। শিল্পনির্ভর সংস্কৃতি আর ওয়াহাবি মতবাদ হাত ধরাধরি করে চলতে পারে না। সামাজিক এবং লৈঙ্গিক বিভাজন বিষয়ে একটি স্থির ধারণা লালন করে থাকে ওয়াহাবি অনুসারীরা। তেলনির্ভর একটি অর্থনীতির সঙ্গে এটি হয়ত সাংঘর্ষিক নয়, কিন্তু শিল্পনির্ভর অর্থনীতির জন্য চাই একটি গতিশীল সংস্কৃতি যেখানে প্রতিদিনই বদলে যেতে পারে সামাজিক সম্পর্কসমূহ।

নতুন এসব পরিকল্পনার বিরুদ্ধে গভীর প্রতিবাদ উঠলেও সেখানে তা প্রকাশের সংস্কৃতি না থাকায় সরব হওয়ার সুযোগ হলো না তার। সালমান তার উপসংহার টানলেন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে, অবশেষে প্রকাশ্যেই প্রতিপক্ষের মোকাবেলায় নামতে হবে তাকে। তা না হলে গোপনেই তার পরিকল্পনা বিনষ্ট করে দিতে পারে শত্রুরা। তিনি ঘোষণা দিলেন, সৌদি নারীরাও এখন থেকে প্রকাশ্যে গাড়ি চালাতে পারবে। ধর্মীয় বুজুর্গদের ওপর প্রত্যক্ষ আঘাত ছিল তার এ ঘোষণা। ভয়াবহ অসন্তোষের ধূম ছড়ালো চারদিক। এরপর দ্বিতীয় ঘোষণা দিলেন বিন সালমান, সৌদি আরামকোর শেয়ার বিক্রি করার। বিনিময় হার নির্ধারণ করবেন তিনি এবং শেয়ার বদল হবে ২০১৮ সালে।

বিদ্যুৎগতি ছোবল হানলেন যুবরাজ : শত বছরের প্রচলিত সৌদি প্রথা ও বিশ্বাসের ওপর প্রথমবারের মতো এ প্রত্যক্ষ আঘাতের কারণে তৈরি হলো অনিবার্য অভ্যুত্থানের হুমকি। বাস্তবে আদৌ কোনো অভ্যুত্থান পরিকল্পনা করা হয়েছিল কিনা- সে প্রশ্ন অবান্তর। অভ্যুত্থানের হুমকিকে তার সিদ্ধান্তের স্বাভাবিক পরিণতি ধরে নিয়েই অগ্রসর হওয়ার মনস্থ করলেন তিনি। যেহেতু অনেক বেশি লোকের স্বার্থের লেজে ইতোমধ্যেই পাড়া দিয়ে ফেলেছেন তিনি, সেহেতু নিজেই প্রথম আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নিয়ে তার বাস্তবায়ন করলেন প্রায় এক ডজন রাজপুত্র এবং অর্ধডজন মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃত প্রত্যেকেই সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর অভিজাত শ্রেণির সদস্য। অত্যন্ত বিপজ্জনক এক জুয়া ছিল এটি। ক্ষমতাবলয়ের ভেতরেও রয়েছে প্রবল বিরোধী শক্তি। কিন্তু কিছু একটা না করে চুপচাপ বসে থাকার উপায় নেই তার। গত শনিবার রাতে যে আক্রমণ তিনি করেছেন, হয় সেটাই তিনি করতে পারতেন, অথবা অপেক্ষা করতে পারতেন শত্রæরা কখন তাদের পছন্দ এবং সুবিধামতো অনিবার্য আক্রমণটি তাকে করে সেটি দেখার জন্য। এখনো যে সব গুছিয়ে এনেছেন তিনি বলা যাবে না সেটা। তবে এ আক্রমণের মধ্য দিয়ে নিঃসন্দেহে, অন্তত নিজের জন্য কিছুটা হলেও বাড়তি সময় জোগাড় করতে সমর্থ হয়েছেন তিনি। সৌদি রাজপরিবার এবং ধর্মীয়নেতাদের ওপর আক্রমণ এক বেপরোয়া পদক্ষেপ, তবে এর ভিতর দিয়ে অর্থপুষ্ট এবং ধর্মধারী চক্রটিকে তিনি ভেঙে দিতে সমর্থ হবেন বলে ভাবছে তার সমর্থকগোষ্ঠী।

সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ এ নাজুক পরিস্থিতির মোক্ষম সুযোগ চিনতে দেরি হলো না কিন্তু বহিঃশত্রুর। গণধরপাকড়ের এক দিন আগে ইরানের মদদপুষ্ট ইয়েমেনের শিয়া হুতিরা ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ল রিয়াদের উদ্দেশে। সৌদিরা এ নিয়ে অভিযোগ তুলল, ইরানই এ ক্ষেপণাস্ত্রের নির্মাতা, যদিও তা অস্বীকার করল তেহরান। রিয়াদে হামলার সিদ্ধান্তটি ছিল গুরুতর পর্যায়ের সিদ্ধান্ত যদিও মাঝপথেই ক্ষেপণাস্ত্রটিকে আটকাতে সক্ষম হয় সৌদিরা।

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির ওপর ইতোমধ্যে প্রবল চাপ তৈরি করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। ২০১৫ সালে পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে খুব বেশি অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হয়নি দেশটিকে এখন পর্যন্ত। বরং এ সময়ে ইরাকের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে তারা। সিরিয়ার বাশার-আসাদ রাজত্ব যে খুব একটা উপকৃত হয়েছে তেহরানের সহায়তা পেয়ে এমন কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে ইরানের প্রাপ্তিযোগ কম নয়। যুদ্ধে অংশ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ধীরে ধীরে তা কাটিয়ে উঠছে হিজবুল্লাহ। লেবাননে আরো জোরালো হচ্ছে ইরানি প্রভাব। যদিও দেশটি নিজেও যাচ্ছে এক বড় সংকটের মধ্য দিয়ে, যেখানে মাত্র গত সপ্তাহে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে গদি ছেড়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী সা’দ হারিরি। তুলনায় সৌদিরা যে খুব একটা ভালো করছে তা বলা যাচ্ছে না। সৌদি নেতৃত্বাধীন হুতিবিরোধী সামরিক জোট ভেঙে গেলেও হুতি নেতৃত্বাধীন সৌদিবিরোধী জোটে ভাঙন ধরেনি এখনো। তার ওপর, কোনো রাখঢাক না রেখেই সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মনে দুঃখ দিয়ে তাদের নতুন শত্রু কাতারের সঙ্গে প্রকাশ্যেই হাত মিলিয়েছে সৌদ গোষ্ঠীর চিরশত্রু ইরান। কিন্তু কী চাইছে ইরান? সে চায় আরো অস্থিতিশীল হোক সৌদি আরব, তার ইরানবিরোধী তৎপরতার তেজ আরো কমুক এবং অবসান ঘটুক সুন্নি অনুসারী ওয়াহাবি প্রতিপত্তির। ইরানের এ স্বপ্নটাই শেষ পর্যন্ত বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকেই।

সৌদি শীর্ষমহলে যুবরাজের এ গণধরপাকড় ইরানের কাছে গর্হিত অপরাধ অবশ্যই। সৌদি আরবের কট্টরপন্থী প্রবীণ আর ধনকুবের অভিজাত গোষ্ঠীর পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। ফলত তারাও এখন বেপরোয়া। গুটি চালার এখনই শ্রেষ্ঠ সময়! যদি তারা ব্যর্থ হয় এ মিশনে তবে অনিবার্য গৃহযুদ্ধে নিপতিত হবে সৌদি আরব। যদি তারা রিয়াদে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে পারে, তখন বিরোধীরা অন্তত এ অভিযোগ আনতে পারবে যে, বাস্তব হুমকির মোকাবেলা না করে কেবল নিজের পরিকল্পনার মোহজালে আটকা পড়ে গেছেন তরুণ যুবরাজ। আর ইরানের জন্য সবচেয়ে ভালো, এ যুদ্ধে কেউই যদি বিজয়ী না হয়। এসব ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, স্বাভাবিকভাবেই ঐতিহাসিক বদলের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের ভ‚রাজনীতি। আর যুক্তরাষ্ট্রের যেহেতু গভীর স্বার্থ রয়েছে সেখানে, তাই এসব বিষয়ে চুপ থাকতে পারবে না সেও। ইরানের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যে তার চাই একজন আঞ্চলিক প্রতিদ্ব›দ্বী। সৌদি আরব বড় শক্তি, কিন্তু যদি তারা ব্যর্থ হয় আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে, স্বাভাবিকভাবেই তখন বিকল্পের খোঁজে নামতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। এর একটি সমাধান হতে পারে মধ্যপ্রাচ্যে আরো একটি নতুন অভিযানে নামা, যে কাজটি এর আগেও করেছে তারা এবং আশাপ্রদ ফল প্রসব করেনি তার কোনোটাই।

বর্তমান প্রেক্ষিতে সৌদি আরবের আধুনিকায়নে মদদ দিয়েই যাবে আমেরিকা। আর কিছু না হলেও এতে সব সময়ই খর্ব হবে ওয়াহাবি রক্ষণশীল মতবাদ। যদিও সে প্রশ্নের পূর্ণ বাস্তবায়ন এখনও দূরস্ত। শনিবারের ঘটনাবলি বিশ্লেষণ থেকে বলতে হবে, এটি হয় সৌদি আরবে এক নতুন যুগের সূচনা অথবা তরুণ যুবরাজের একটি উচ্চাভিলাষী নিরীক্ষার অকালমৃত্যু। সৌদি আরবের ক্ষমতাকেন্দ্রে এর পরিণতিতে যাই ঘটুক তাতে প্রতিফলিত হবে সৌদি আরবের অর্জিত দুর্বলতার গল্পটাই। গল্পটি ইরানের জন্য আনন্দের এবং আমেরিকার জন্য বেদনার। সৌদি সমাজে সূচিত এসব নতুন পরিবর্তন ধরে রাখতে উৎসাহী যুবরাজকে উৎসাহ দিয়ে যাওয়ার ধারণাটি আপাতবুদ্ধিতে ‘উত্তম’ মনে হতে পারে, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে, এরই কারণে সেখানে যে কোনো সময় টালমাটাল হয়ে যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অবস্থানটিও।

(জিপিএফ অবলম্বনে)

মিলটন মোললা : সাংবাদিক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App