×

মুক্তচিন্তা

আওয়ামী লীগের কাছে প্রত্যাশা

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:১১ পিএম

স্বল্পতম সময়ে দ্রব্যমূল্য, বাজার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং যোগাযোগের দুর্ভোগ কমিয়ে সাধারণের মন থেকে বিরক্তিবোধ প্রশমন করতে হবে। আরো জানি যে, আগামী নির্বাচনে ভোট দেয়া-নেয়ার ক্ষেত্রে এসব অঙ্কই সাধারণের মাথায় থাকবে। এসব সমস্যা আওয়ামী লীগের মাথা থেকে যেন উধাও না হয়।

কাল-অকালের কাহনকথা

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন প্রায়। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে জাতির সম্মুখে একটি স্বপ্নমাখা রূপকল্প প্রস্তাব করেছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সে সময়ে প্রদত্ত সেই রূপকল্পটি আসলে ছিল বাঙালি জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের এক স্বপ্ন, জাতিকে আত্মমর্যাদাশীল করার এক স্বাপ্নিক পরিকল্পনা। একটি নির্দিষ্ট সময়ে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন একটি নির্দিষ্ট স্তরে উন্নীত করার অঙ্গীকারই প্রকৃতপক্ষে রূপকল্প বা ‘ভিশন ২০২১- ইংরেজিতে আমরা শুনেছি ‘ভিশন টুয়েন্টি টুয়েন্টি ওয়ান’। স্বপ্ন-কল্পনায় মাখা এই স্লোগানটি যে যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ‘ভিশন টুয়েন্টি টুয়েন্টি ওয়ান’-এর লক্ষ্যমাত্রার কোনো কোনো সূচকে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করেছে। ২০২১ সালের মধ্যে আরো কিছু সংখ্যক উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ তার এই অব্যাহত অভিযাত্রায় সচল থেকে স্লোগানে বর্ণিত রূপকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতা দেখাবে। ইতোমধ্যে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। ২০২১ সালে আমরা যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করব তখন এ দেশের দারিদ্র্যের হার আরো বহুলাংশে হ্রাস পেয়ে তা প্রায় শূন্যের ঘরে নেমে আসবে। তখন আমরা আমাদের বক্তব্য-বিবৃতি-ভাষণে অতীতচারিতার আশ্রয় নিয়ে হয়তো বলব, ‘একদা আমরা দরিদ্র ছিলাম’। আবার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিজয়ী আওয়ামী লীগের সরকার ঘোষণা করেছিল ‘রূপকল্প ৪০৪০’ বা ‘ভিশন ফোরটি ফোরটি’। এই চলমান রূপকল্পের পশ্চাতে ক্রিয়াশীল আছে ‘উন্নত রাষ্ট্রে’র অভিযাত্রায় আমাদের উৎসাহ। আর আমাদের স্বপ্ন কার্যকর আছে একটি ‘উন্নত রাষ্ট্রে’র নাগরিকে পরিণত হওয়ার। জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের স্বপ্ন দেখিয়ে আমাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য অন্তর্গতভাবে সক্রিয় করে তোলেন। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন তার সব দিকনির্দেশনা কিংবা রূপকল্প বাস্তবায়নে জননেত্রীর দেয়া ফর্মুলার মতো কাজ করলে অবশ্যই ‘উন্নত রাষ্ট্রে’র ঠিকানা খুঁজতে ৪০৪০ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না, তার আগেই আমরা আমাদের লক্ষ্যবিন্দু স্পর্শ করতে সক্ষম হব। আর তা যখন সম্ভব হয়ে উঠবে তখন কেউ যদি বাঙালির দরিদ্র চেহারা দেখতে চায় তবে তাকে সত্যি সত্যিই ‘জাদুঘরে’ যেতে হবে। দরিদ্র বাঙালির সন্ধান করতে চাইলে হয়তো ঐতিহাসিক বা প্রতœতাত্তি¡ক গভীর খননের আশ্রয়ও নিতে হতে পারে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাঙালির দারিদ্র্য অতীত হবে, বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে এক উন্নত ও মানবিক রাষ্ট্র।

কিন্তু এসব করতে গেলে কিংবা উন্নত রাষ্ট্রের বাস্তবায়ন দেখতে হলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুনরায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে। আমাদের বিবেচনায় এটিও খুব কঠিন কোনো কাজ নয়। তাছাড়া এ দেশের সাধারণ মানুষেরও নিবিড় প্রত্যাশা যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আনন্দ শোভাযাত্রার শুভ উদ্বোধন করবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। নানা কারণে বাংলাদেশের মানুষের এই প্রত্যাশা দিন দিন গভীরতর হচ্ছে। বিশ্ব রাজনৈতিক পরিমণ্ডল জননেত্রীর অবস্থান, মানবতার পক্ষে তার আপসহীন মনোভাব শেখ হাসিনাকে তামাম দুনিয়ার অবিসংবাদিত নেতায় উত্তীর্ণ করেছে। এছাড়া মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের নিরীহ মানুষকে হত্যা, খুন ও ধর্ষণের মতো অমানবিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অপরাধে যুদ্ধাপরাধীর বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করাও জননেত্রী শেখ হাসিনার অনন্য রাজনৈতিক অবদান। মহান মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ও নির্যাতিত পরিবারের সদস্যরা শেখ হাসিনার এ অবদানের কথা কেমন করে ভুলে যাবেন? উল্লেখের কোনো অবকাশ নেই যে, বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা এ দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত না হলে এমন বীর ও নায়কোচিত এবং দুঃসাহসী কাজ কেউ করতে পারত না। একদিকে বিশ্বের নানা প্রান্তের নানা ধরনের হুমকি এবং অপরদিকে বিএনপির আন্তর্জাতিক লবিস্টদের নানা অপতৎপরতা আর তদীয় দুষ্টচক্রের বশংবদ গণমাধ্যমের হুঙ্কারজনিত চোখ রাঙানি জননেত্রী শেখ হাসিনাকে টলাতে পারেনি বিন্দুমাত্র। তাই সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের সহজ সরল প্রত্যাশা এই যে, ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’র সব উৎসব আর আনন্দ মিছিলের অগ্রভাগে নেতৃত্ব দেবেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়নের কাণ্ডারি বিশ্বনেতা ও বিশ্বমানবিকতার জননী জননেত্রী শেখ হাসিনা।

কিন্তু এই স্বপ্ন নিয়ে আমাদের মনে মাঝেমধ্যে কিছু আশঙ্কাও উঁকিঝুঁকি মারে! এই আশঙ্কা সাধারণ মানুষের ভোট নিয়ে নয়। দুঃখজনক হলো আমাদের মনে এই আশঙ্কা জাগ্রত হয় আওয়ামী লীগের ভেতরকার সাংগঠনিক দুর্বলতা দেখে, কিছুসংখ্যক নেতাকর্মীর কর্মকাণ্ড দেখে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয় দলটির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের চেহারা দেখে আমরা শঙ্কিত হয়ে উঠি। আবার শুধু কোন্দল বা সাংগঠনিক দুর্বলতাই নয়, তার বাইরেও কিছু কিছু বিষয় আছে যা নির্বাচনকালে জনগণের ভোটে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এসবের মধ্যে অন্যতম সেবা নাগরিক সেবা। আওয়ামী লীগের সরকার এ দেশের জনগণকে সরাসরিভাবে উপভোগ্য কিরূপ সেবা নিশ্চিত করতে পেরেছে সে হিসাবটিও ভোটারদের বিবেচনায় উঠে আসবে। বরাবরই সাধারণ ভোটার বা নির্বাচনী পরিভাষায় ফ্লোটিং ভোটার বা ‘ভাসমান’ ভোটাররা ভোটদানের আগে বিগত বছরগুলোতে পাওয়া সরকারি সেবা তথা নাগরিক সুবিধাদির কথা বিবেচনায় রাখে। এটিই নিয়ম- সব সময়ই তা হয়ে থাকে। নাগরিক সুবিধার মধ্যে অন্যতম বাজার স্থিতিশীল রাখা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং সর্বোপরি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। কিন্তু আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষার্ধে এসে আমরা বাজার ও দ্রব্যমূল্যের যে লাগামহীন অস্থিতিশীলতা দেখছি তাতে সরকার বা দলের গৃহীত পদক্ষেপ আমাদের আশান্বিত করতে পারেনি, আমাদের মনে হতাশা জন্মেছে। বাজার ও দ্রব্যমূল্যের পরে যে বিষয়টি আমাদের তাড়া করে ফেরে তা হলো যোগাযোগ। এই যোগাযোগ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সর্বত্রই। প্রকৃতিতে কিছুটা ভিন্নতর হলেও সমস্যার মূল একই জায়গায়। রাজধানীর ভেতরকার ট্রাফিক জ্যামের কারণে এক স্থান থেকে যেমন অন্য স্থানে যাতায়াত তথা যোগাযোগ এখন আর ঘড়ি ধরে সম্ভব হয় না। আবার এই ট্রাফিক জ্যামের পাশাপাশি রয়েছে রাস্তার বেহাল অবস্থা। রাজধানী সবার নজরে থাকার পরও নগরীর এই অবস্থা হলে রাজধানীর বাইরের সড়কপথের অবস্থা খুব ভালো হবে না তা বুঝা যায়। একটানা ৫ কি.মি. রাস্তা দেশের কোথাও স্বাভাবিক ও সুস্থ আছে কিনা তাও সন্দেহের বিষয়। আবার দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে যেসব অঞ্চলে সড়কের মেরামত বা পুনর্নির্মাণ চলছে সেখানকার যাতায়াতের দুর্ভোগ যে কী পরিমাণ অমানবিক পর্যায়ের তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ জানে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকাংশে স্বাভাবিক থাকলেও মাঝেমধ্যে গুম-খুনের ঘটনা সাধারণকে উদ্বিগ্ন ও বিরক্ত করে তোলে। সুতরাং প্রত্যহ বিরক্ত বোধকারী জনগণের বিরক্তির প্রকাশ নির্বাচনে ঘটে গেলে তা হবে জাতির প্রত্যাশার মূলে ছুরিকাঘাত!

দলীয় বা ফ্লোটিং যে ধরনের ভোটারই হোক না কেন আগামী নির্বাচনে তারা কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় থাকবেন বলেই আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে। প্রায় আট বছরের শাসনকালে দলটি কতটুকু সাংগঠনিক দক্ষতা অর্জন করেছে তার পরিচয়ও পাওয়া যাবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে। কিন্তু সে পরিচয়ের অভিজ্ঞতা যদি তিক্ত হয় তবে আমাদের স্বপ্ন, আশা-আকাক্সক্ষা সবই ধূলিসাৎ হবে। এসব দুশ্চিন্তা আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীদের মধ্যে কতটুকু আছে কিংবা আদৌ আছে কিনা জানি না। তবে বিরাটসংখ্যক সাধারণ ভোটার তথা ফ্লোটিং ভোটারদের দুশ্চিন্তা আছে। বিগত বেশ কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচনে ভোটারদের নানাভাবেই বিভ্রান্ত করেছেন সরকারদলীয় নেতা ও কর্মীরা। দলীয় কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে একই দল থেকে যখন বিদ্রোহী কেউ প্রার্থী হয়েছেন স্বাভাবিকভাবেই সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটের দ্বিধাবিভক্তি ঘটেছে। অনেক সময় দেখেছি সাধারণ ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত রেখেছেন নিজেদের। ফলে অনেক এলাকায় স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে একেবারেই নিষ্প্রাণভাবে। আবার দুঃখজনক যে, এরকম বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হার মেনে পরাজয় বরণ করে নিতে হয়েছে সরকারদলীয় প্রার্থীদের। এতে সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং একইভাবে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। আবার এমন কথাও বাজারে চালু আছে যে, সাধারণ মানুষ কখনো খুশি হয়ে বিএনপিকে ভোট দেয় না- তারা আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীর ওপর বিরক্ত হয়ে বিএনপি বা অন্যত্র ভোট প্রদান করে। অতএব আওয়ামী লীগ যদি নিজে সংগঠিত ও সুশৃঙ্খল থাকতে পারে তবে আগামী নির্বাচনেও তার কোনো আশঙ্কা থাকার কথা নয়।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ কী উপায়ে দলের কোন্দল মিটাবে, কীভাবেই বা দ্রব্যমূল্য ও বাজারসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে তা আমরা জানি না। আমরা জানি, স্বল্পতম সময়ে দ্রব্যমূল্য, বাজার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং যোগাযোগের দুর্ভোগ কমিয়ে সাধারণের মন থেকে বিরক্তিবোধ প্রশমন করতে হবে। আরো জানি যে, আগামী নির্বাচনে ভোট দেয়া-নেয়ার ক্ষেত্রে এসব অঙ্কই সাধারণের মাথায় থাকবে। এসব সমস্যা আওয়ামী লীগের মাথা থেকে যেন উধাও না হয়।

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App