×

মুক্তচিন্তা

নভেম্বরের ভাবনা ও দুর্ভাবনা

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০১৭, ১০:২৭ পিএম

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া

আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারি না। পারলে সবাই মিলে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কাজ করতাম। তাদের সঠিক তালিকা হতো। তাদের নাম-ঠিকানা পরিচয় পাওয়া যেত। তাদের উদ্দেশ্য বোঝা যেত। বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভব হতো। সর্বোপরি আমরা এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারতাম। শুধু আবেগে সেটা সম্ভব না জেনেও সারাদেশ এমনকি বাইরের বাংলাদেশিরাও আছেন শেখ হাসিনার সমালোচনায়।

নভেম্বর এলেই বিপ্লবের নামে জেগে ওঠা মানুষদের ভয় পেতে হয়। এক নভেম্বরে কর্নেল তাহের বড়, তো আরেক নভেম্বরে জেনারেল জিয়াউর রহমান। কখনো বলা হয় খালেদ মোশাররফ ছিলেন হঠকারী, কখনো বলা হয় দেশপ্রেমিক। অথচ আমরা একবারো ভাবি না যে খন্দকার মোশতাকের গালে চড় কষিয়েছিলেন কে? কার উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের সরকার ফিরিয়ে আনা? এই নভেম্বরে তথ্যমন্ত্রী বলেছেন তারা মানে তিনি মেনন দীলিপ বড়–য়া বা এরশাদ না থাকলে আওয়ামী লীগ নাকি রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরবে। বটেই। এতদিন পর তিনি বুঝেছেন তারা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। একমাত্র এরশাদকে বাদ দিলে বাকিরা জামায়াত জামায়াত খেলায় বিএনপির সঙ্গে পারবে কিনা সে নিয়ে আমার মতো অনেকের সংশয় থাকলেও নভেম্বরের বিপ্লবীরা এ মাস এলেই কেমন জানি আউলা হয়ে ওঠেন। আমরা এদের নিয়ে ভাবার চাইতে দেশের রোহিঙ্গা সমস্যা আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকেই দৃষ্টি ফেরাব।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময় সোজাসাপ্টা কথা বলেন। তার জীবনের ঝুঁকি থাকার পরও তিনি সত্য কথা বলতে দ্বিধাহীন। এখন দেশে চলছে রোহিঙ্গা সমস্যা। ভয়াবহ এই সমস্যা বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাবে বলা মুশকিল। এটা কেবল মানবিক বিপর্যয় বললে ভুল হবে। গত ক’দিনের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, এখন যারা আসছে তাদের পালিয়ে আসার কারণ অস্পষ্ট। এটিএন নিউজের প্রতিবেদনে দেখলাম মধ্যবিত্ত উচ্চ মধ্যবিত্তদের পালিয়ে আসার রহস্যভেদের রিপোর্ট। না আছে তাদের পালানোর মতো উদ্বিগ্ন চেহারা, না দেখলাম তাদের মুখে ভয়ের ছাপ। তারা সে দেশে বেঁচে থাকার পেছনে যেসব আয়-রোজগারের উল্লেখ করছেন সেগুলোও হাস্যকর। তাদের নিয়ে আসা জিনিসপত্র বাঁধাই-ছাদাই দেখে এটা মনে হতে পারে তারা আসার জন্য পর্যাপ্ত সময় পেয়েছিল। এখন এটা যদি ভয়ের কারণে প্রস্তুতি হয় তো বলার কিছু নেই। আর যদি তারা মনে করে থাকে বাংলাদেশ তাদের সেইফ হেইভেন বা নিরাপদ ভূমি তবে আমাদের আতঙ্ক আরো একধাপ বাড়ল বৈকি।

খবরে দেখলাম প্রধানমন্ত্রী বলেছেন কোনো ধরনের উত্তেজনা বা প্রভোকশানে যেন পা না দেই আমরা। এই প্রাজ্ঞচিন্তা বা বাস্তবতা তিনি বোঝেন। কারণ তিনি এই রাষ্ট্র ও জনগণের অভিভাবক। অথচ একদল মানুষ যারা বুদ্ধিজীবী বা সুশীল নামে পরিচিত তারা সমানে উসকানি দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মতলব বোঝা কঠিন কিছু না। বাংলাদেশ এখন এমন এক সময় পার করছে যখন তার পেছনে ফিরে তাকানোর সময় নেই। সে সময় হঠাৎ করে এমন একটা ভয়াবহ সমস্যার চাপ কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। মিয়ানমার এমন এক দেশ যাদের ইতিহাসে গণতন্ত্র কখনোই ছিল না। মগের মুলুক নামে পরিচিত এই মুলুকের লোকজন চাপে না পড়লে কথা শোনে না, মানেও না। তাদের ফাইটিং মনোভাবের বিষয়টি দুনিয়াও ভালো জানে। প্রশ্নটা এমন না যে আমরা যুদ্ধে গেলে হেরে যাব বা পারব কি পারব না? আমাদের প্রশ্ন আমরা এই অসম এবং অহেতুক লড়াই চাই কিনা? ইতোমধ্যে মিয়ানমার তার উসকানি অব্যাহত রাখতে আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করছে। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে এক সময় না এক সময় কোনো না কোনোভাবে হয়তো তার উত্তর দিতেই হবে। আর তখনই লেগে যাবে যুদ্ধ কিংবা যুদ্ধের মহড়ায় ব্যয় হবে কোটি কোটি টাকা। যাতে এই দেশ ও জাতির উন্নয়ন এবং সম্ভাবনাই বিনষ্ট হবে মাত্র।

আন্তর্জাতিক বলয়ে আমাদের কূটনীতি ও রাজনীতির কতটা গুরুত্ব বা কীভাবে আমরা অন্যদের তা বোঝাতে পারি সেটা প্রমাণের সময় হাজির। এমন না যে আমরা বললেই তারা বুঝে যাবেন। ইতোমধ্যে ভারত, রাশিয়া, চীন কোনো না কোনোভাবে মিয়ানমারকে সমর্থন জানিয়েছে। এই খবরটা যত বেশি প্রচারিত হয়েছে ততটাই ঢাকা পড়ে গেছে তারা কি আমাদের বিরুদ্ধে? না তারা বলেছে এসব হতভাগ্য শরণার্থীকে রেখে দেয়াটাই বাংলাদেশের দায়িত্ব? তারা যদি তা না বলে থাকেন তবে তো এটা স্পষ্ট পথ দুদিকেই খোলা। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তো তাদের কোনো কথা নেই। সুতরাং ক‚টনীতির দায় কী? সরকার ও জনগণের টাকায় দেশভ্রমণ না লবিং তৈরি করা? কেন আমরা সরজমিন তাদের ডেকে এনে বোঝাতে পারব না যে এরা আমাদের মানুষ না। খবরে তো এও দেখলাম ভারতের ত্রাণের পরিমাণ সর্বাধিক। তো কারা দিচ্ছে এই ত্রাণসামগ্রী? এগুলো তো হাওয়ায় উড়ে আসেনি? ফলে লবিং গ্রুপ তৈরি তো সময়ের ব্যাপার মাত্র। একাত্তরের সঙ্গে ঘটনার তুলনা দিতে আগ্রহীরা এটা বলছেন না যে, সে সময় চীন, মার্কিন বা ইউরোপের দেশগুলো সবাই আমাদের বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু সেসব দেশের সামাজিক গ্রুপ বা লবিং এগিয়ে এসেছিল মুক্তিযুদ্ধে সাড়া দিয়ে। তারা বুঝতে পেরেছিল কতটা নির্মম আর ভয়ঙ্কর ছিল পাকিদের অত্যাচার। কলকাতার উপকণ্ঠে সল্টলেকের পানির পাইপে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের সঙ্গে কেনেডির ছবি দুনিয়াকে নাড়া দিয়েছিল ব্যাপকভাবে। সঙ্গে ছিল জাতিসংঘ ও অন্যান্য দেশের সামাজিক ব্যক্তিত্ব নেতা বা বড় মানুষদের আনাগোনা। এভাবেই দুনিয়ায় আমরা আমাদের দিকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাদের আগ্রহী ও সমর্থক করে তুলেছিলাম।

আজো আমরা গর্ব করি রবিশংকর, জর্জ হ্যারিসনদের নিয়ে। আমাদের ইতিহাসে সংস্কৃতিতে জর্জ হ্যারিসনের বাংলাদেশ কনসার্ট অমর হয়ে আছে। আছে নানা দেশে এমন সব আয়োজনের ঘটনা। সিডনিতে আমার এক সহকর্মী গল্প করেছিল তার বড় ভাইকে নিয়ে। তখন মাত্র গোটা দশেক বাঙালি পরিবারের বসবাস ছিল এখানে। তারপরও দোকানে দোকানে লিফলেট পোস্টার আর মিডিয়ায় তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া নৃশংসতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল মানুষ। তার ভাইও গান গেয়েছিল আমাদের মুক্তি কামনায়। কই রোহিঙ্গাদের নিয়ে বা রোহিঙ্গা সমস্যার আলোকে বাংলাদেশের অভাবনীয় পরিবেশ ও কষ্ট বা সমস্যা নিয়ে তেমন কোনো আয়োজন নেই কেন? যা দেখছি তার নাম মানবিকতা না সাম্প্রদায়িকতা তাও তো স্পষ্ট না। মাঝে মাঝে তো এমনো মনে হয় রোহিঙ্গারা মুসলমান না হলে আমরা হয়তো অন্য পথ বেছে নিতাম।

সত্যি যদি আমরা তাদের দেশে ফেরত পাঠাতে চাই সত্যি যদি আমরা মনে করি তাদের ভালোভাবে বাঁচার ও সমস্যার সঠিক সমাধান চাই তাহলে এ জাতীয় কাজ ও উদ্যোগের মাধ্যমে বিশ্বের মনোযোগ ফেরানোর বিকল্প কোথায়? সেটা না করে যারা ভুল বলছেন তাদের বলি, আমি শেখ হাসিনাকে সমর্থন করি। কারণ যারা মদদ দিচ্ছেন, বায়বীয় দেশপ্রেমে অকারণে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা চাইছেন, তাদের মুখ ও কলম সামলে রাখলেই জাতি উপকৃত হবে। বয়সী কবি নির্মলেন্দু গুণও যুদ্ধে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে কবিতা লিখেছেন। অথচ তার যে বয়স আর শরীরের হাল তিনি গোলাগুলির শব্দও নিতে পারবেন না। যৌবনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নেয়া যে কেউ যখন রোহিঙ্গাদের জন্য আমাদের দেশকে যুদ্ধে পাঠাতে লেগে পড়েন তখন বুঝতে হয় সস্তা জনপ্রিয়তা নয় তো সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছাড়া আর কিছুই নেই এর পেছনে। এসব ফালতু চিন্তা বাদ দিয়ে ক‚টনৈতিক সমাধান আর সমাধান-যোগ্য বাস্তবতার কথা ভাবাই জরুরি। মনে রাখা প্রয়োজন একবার সমাধানের পথ খুলে গেলে এবং সিংহভাগ শরণার্থীদের ফেরত পাঠাতে পারলেই আমরা পরবর্তী কৌশল ঠিক করতে পারব। আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, জনগণ ও সমাজ মিলে তখন মিয়ানমারকে একটা উপযুক্ত জবাব দেয়ার পথও বেরিয়ে আসবে।

মিয়ানমার সহজ দুশমন না। তাদের যে একটা প্ল্যান আছে নীল নকশা আছে সেটা এখন স্পষ্ট। তারা যা করছে বুঝেশুনে করছে। তাদের কাজ তারা করেই যাচ্ছে। আর তারা জাতিগতভাবে ঐক্যবদ্ধ। আমরা? এমন কঠিন সময়েও বিএনপি পাশে দাঁড়াতে পারেনি। তাদের নেতা মুখে কুলুপ এঁটে আছেন। আর সচিব ও পাতি নেতারা যা মুখে আসছে তাই বলছেন। এই দলটির সৌভাগ্য মানুষের প্রচ্ছন্নতায় তার প্রতি দুর্বলতা আছে। কিন্তু তার কোনো সঠিক ব্যবহার তারা করেনি। এমন কঠিন সময়েও সেই জনমতকে মানুষ ও দেশের কল্যাণে লাগাতে পারছে না। অথচ দরকার এখন বজ্রকঠিন ঐক্যের। ভারতের নিন্দারত মানুষদের বলি এর চেয়ে অনেক সহজ সমস্যাতেও তারা এক সুতোয় ঐক্যবদ্ধ থাকেন। আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারি না। পারলে সবাই মিলে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কাজ করতাম। তাদের সঠিক তালিকা হতো। তাদের নাম-ঠিকানা পরিচয় পাওয়া যেত। তাদের উদ্দেশ্য বোঝা যেত। তাদের জন্য বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভব হতো। সর্বোপরি আমরা এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারতাম। শুধু আবেগে সেটা সম্ভব না জেনেও সারাদেশ এমনকি বাইরের বাংলাদেশিরাও আছেন শেখ হাসিনার সমালোচনায়। এবার মাঠে নামলেন সরকারের মন্ত্রী। এই নভেম্বর কি আমাদের আবার সাবধান হওয়ার ঈঙ্গিত দিচ্ছে? মনে রাখা দরকার এবার পা ফসকালে ক্র্যাচের কর্নেলের মতো সারাজীবন ক্র্যাচেই কাটাতে হবে এই জাতিকে। আওয়ামী লীগ কি করবে জানি না। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সাবধানে রাখাই জাতীয় দায়িত্ব।

সিডনি থেকে অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App