মণিপুরী সম্প্রদায়ের ১৭৫তম মহারাসলীলা
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০১৭, ০৪:২৩ পিএম
বাংলাদেশের মণিপুরী সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব মহারাসলীলা। শত বছরের ঐতিহ্য নিয়ে এবারো রাসলীলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর গ্রামের জোড়ামন্ডপে এ বছর ১৭৫তম রাসমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই উৎসবকে ঘিরে প্রতি বছর লাখো মানুষের মিলনমেলা হয়। মণিপুরী ললিতকলা একাডেমির প্রাঙ্গণে দুপুর ১২টা থেকে গোধূলি লগ্ন পর্যন্ত চলে গোষ্ঠলীলা রাখালনাচ (স্থানীয় ভাষায় রাখুয়াল)। শ্রীকৃষ্ণ, সখা বলরাম ও অন্যান্য রাখাল বালকদের গোষ্ঠে গরু চরাতে গিয়ে সম্মুখীন নানা ঘটনার চিত্র এই রাসে রূপায়িত হয়। ১২টি কলাগাছ দিয়ে বেষ্টিত তিনটি পৃথক মঞ্চে শতাধিক তরুণ ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত হয়ে এই রাখাল নৃত্য বা গোষ্ঠলীলায় অংশ নেয়। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মন্ডপ গুলোতে চলে লোক-ঐতিহ্যমূলক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রাত ১১টা থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত চলে শ্রী শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলা। সাদা কাগজ দিয়ে কারুকার্যময় নকশায় সাজানো মন্ডপ গুলোতে অপূর্ব মণিপুরী নৃত্যভঙ্গিমায় সারারাত ধরে চলে রাস পরিবেশনা। রাস উৎসব প্রাঙ্গণে বসে বিরাট গ্রাম্যমেলা। মেলায় অন্যান্য স্টলের পাশাপাশি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার বই ও পত্রিকার অনেকগুলো স্টল থাকছে। মণিপুরী ভাষার অডিও, ভিডিও গানের ক্যাসেট বা সিডির দোকানও আছে। তাছাড়া রাসমেলায় মণিপুরী হস্তচালিত তাঁতের কাপড়ের প্রদর্শনী ও বিক্রির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মেলা প্রাঙ্গণে থাকছে মণিপুরি থিয়েটারের স্টল।
বৈষ্ণব সাহিত্যের রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার এক নৃত্যগীতাভিনয় অনুষ্ঠান হচ্ছে রাসলীলা। রাস শব্দটি রস শব্দের বিবর্তিত রূপ বলে অনুমান করা হয়। মণিপুরীদের প্রথম রাসলীলা অনুষ্ঠান হয় মণিপুরীদের আদিভ‚মি মণিপুরে ১৭৬৯ খিস্টাব্দে রাজা ভাগ্যচন্দ্র সিংহের আয়োজনে। ১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেট ভ্রমণে এসে মাছিমপুর পল্লীতে রাস নৃত্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। পরে কবিগুরু কমলগঞ্জের নৃত্য শিক্ষক গুরু নীলেশ্বর মুখার্জীকে শান্তি নিকেতনে নিয়ে গিয়ে প্রবর্তন করেছিলেন মণিপুরী নৃত্য শিক্ষা।
অষ্টাদশ শতকে বাংলাদেশের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলায় বসতি স্থাপনকারী মণিপুরীরা আজ থেকে ১৭৪ বছর পূর্বে প্রথম তাদের ধর্ম-সংস্কৃতির প্রধান উৎসব রাসলীলার সূচনা করে। মাধবপুর জোড়ামন্ডপে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়ের আয়োজনে এবং মণিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হয় রাসলীলা। জোড়ামন্ডপের প্রথম সেই রাসলীলানুকরণে বৃন্দার ভ‚মিকায় ছিলেন রাণী চ্যাটার্জী, রাধা ও কৃষ্ণের ভ‚মিকায় ছিলেন থাম্পাল সিনহা ও বাবুল সিংহ, রাসধারী বা রাসের পরিচালনাকারী ছিলেন বকসাল সিংহ ও সহযোগী সাংকয় সিংহ। প্রাথমিক অবস্থায় কেবল রাত্রিতে শারদীয় রাস অনুষ্ঠিত হলেও পরবর্তীতে দিবাভাগে গোষ্ঠলীলা যোগ করা হয়। ১৮৪২ সাল থেকে শুরু হওয়া এই উৎসব শুধুমাত্র ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ব্যতীত অদ্যাবধি মণিপুরীরা প্রতি বছরই জোড়ামন্ডপে উদযাপন করে আসছে