×

মুক্তচিন্তা

মানববোমা বুকে বেঁধে আছি

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০১৭, ০৭:২৭ পিএম

যশোরের হিসাব যদি ৬৪ জেলাতে হয় তবে আমরা বেকারদের কত বড় একটা বোমার ওপর বসে আছি? কেবল ৩০ হাজার কেন ভাবছি আমরা? বস্তুত সে দিন তো যশোর জেলার সব শিক্ষিত বেকার জমা হয়নি। ৩০ হাজারের বদলে লাখ খানেক আবেদন তো যশোরেই থাকতে পারে। আমি অবিলম্বে এই শিক্ষিত বেকারদের জন্য পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণের আয়োজন করার অনুরোধ করি।

একদিন প্রতিদিন

আমাদের কোনো ধারণাতেই বোধহয় এই ভাবনাটি আসে না যে আমরা পরমাণু বা হাইড্রোজেন বোমার চেয়ে ভয়াবহ একটি বোমা আমরা জাতির বুকের মাঝে বেঁধে রেখেছি। বাংলাদেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান করাটি হলো সেই বোমা। বহুদিন যাবৎই আমি এই কথাগুলো বলে আসছি যে, দেশের শিক্ষিত মানুষদের বেকারত্ব ক্রমশ একটি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমরা যদি এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সহসা জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ না করি তবে আমাদের বুকে বাঁধা এই মানববোমা বিস্ফোরিত হয়ে পুরো দেশটাকেই বিপন্ন করে তুলতে পারে। বিষয়টি আমাদের নীতিনির্ধারকদের তেমনভাবে ভাবিত করছে এমনটি মনে হয় না। মিডিয়ায় আমরা লাখ লাখ বেকারের খবর পড়ি। একটি চাকরির জন্য শত শত আবেদন পড়ে সেটিও দেখি। চাকরির জন্য প্রতিদিন শত শত অনুরোধ, সুপারিশ ইত্যাদিও এখন গা সওয়া। তেমন একটি অবস্থাতেই আমার এই ভাবনার বাস্তব প্রকাশ দেখলাম ৫ অক্টোবর ১৭ যশোরের শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে।

৫ অক্টোবর ১৭ যশোরের শংকরপুরে স্থাপিত দেশের প্রথম ও একমাত্র পূর্ণাঙ্গ এসটিপি শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে চাকরি মেলার আয়োজন করা হয়। ঢাকা থেকে ৩০টি প্রতিষ্ঠান তাতে অংশ নেয়। সেই পার্কে অবস্থানরত একটি প্রতিষ্ঠানও তাতে অংশ নেয়। পার্কের দোতালায় স্টল সাজিয়ে চাকরিপ্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবেই চাকরি দেয়ার আয়োজন ছিল সেটি। আয়োজনটি কার্যত ভণ্ডুল হয়ে যায়। কোনো চাকরিদাতা প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নিতে পারেনি। কোনো চাকরিপ্রার্থী সাক্ষাৎকার দিতেও পারেনি। চাকরিপ্রার্থীরা সংখ্যায় এত বেশি ছিল যে পুলিশকে লাঠিচার্জ করে তাদের সরাতে হয়েছে। পার্কের উন্মুক্ত সব জায়গা চাকরির আবেদনকারীরা দখল করে ফেলেছিল। যশোর থেকে ফিরে এসে জানা গেল যে ওখানে ৩০ হাজারের বেশি আবেদন জমা পড়েছিল। যা ঘটেছে তার সব স্তরের ছবিই আমি তুলেছি বা সংগ্রহ করেছি। তবে সবার ওপরে আছে সে দিন জমা দেয়া চাকরিপ্রার্থীদের জীবনবৃত্তান্তের স্তুপ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, হাইটেক পার্কের সভা, সেমিনার সবই ছবিতে উঠে এসেছে। ফেসবুক ভরে গেছে এসব ছবিতে। অনেক মিডিয়ায় খবরও হয়েছে। তখনই দেখলাম বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর এ বিষয়ে ছোট অথচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। ফাহিমের স্ট্যাটাসটা আমাকে ট্যাগ করা। তাই সেটি সরাসরি কেউ পড়তে পারেন। আমার এই নিবন্ধের পাঠকদের জন্য সেটি আমি এখানে উদ্ধৃত করছি।

ফাহিম লিখেছে, ‘ফেসবুকে যশোরে অনুষ্ঠিত চাকরি মেলার ছবি দেখছিলাম। দেশে শিক্ষিত বেকার সমস্যা যে কি ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে, এটির একটি খণ্ড চিত্র এটি। গত কয়েক বছর ধরে বলে আসছি আমরা আসলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সুবিধা নেয়ার মতো অবস্থা তৈরি করতে পারছি না। আসলে আমরা ধাবিত হচ্ছি ভয়াবহ এক ডেমোগ্রাফিক ডিজাস্টারের দিকে। হতাশাগ্রস্ত লক্ষ্যহীন কোটি কোটি কর্মহীন তরুণ (লাখ লাখ শিক্ষিত স্কিলহীন বেকার) আমাদের এ সমাজের সবকিছুকে, স্থিতিশীলতাকে, যা কিছু অগ্রযাত্রাকে লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে যে কোনো সময়। এক ভয়ঙ্কর টাইম বোমা হাতে নিয়ে বসে আছি আমরা সবাই।’

ফাহিমের স্ট্যাটাসে আমি নিচের মন্তব্যটা করেছি।

‘৫ অক্টোবর ১৭ আমি যশোরে ছিলাম। নিজের চোখে দেখেছি। হাজার হাজার তরুণ-তরুণী কাগজের খয়েরি খাম হাতে পুলিশের বকা-লাঠি-গুঁতা খেয়েও দুপুর অবধি কেবল সিভিটা জমা দেয়ার চেষ্টা করেছে। সেমিনারের মেঝেতে বসে আমাদের বাণী শুনেছে। অনেকে প্রশ্নও করেছে। এমন অবস্থা এর আগে বাংলাদেশের কোথাও আমি আর কখনো দেখিনি। তখনই মনে প্রশ্ন জেগেছে ওদের দিয়ে আমরা কি করব। যাতে ওদের মন না ভাঙে সেজন্য বলে আসছি দেশের মানচিত্রটা বুকের মাঝে রাখ, সৎ হও, আন্তরিক হও এবং দক্ষতা অর্জন কর। ভেবনা আইটি মানেই কেবল কম্পিউটার বিজ্ঞানের দক্ষতা, কোড লেখা বা প্রোগ্রামিং করা নয়। আইটির সঙ্গে ৪ হাজার ৮শ রকমের পেশার সম্পর্ক আছে। তার জন্য দক্ষতা প্রয়োজন। কিন্তুু সমস্যাটা অন্যরকম। ওরা তো শিক্ষার্থী নয় যে ওদের পাঠক্রম, পাঠ্যবই, পাঠ্যবিষয়, পাঠদান ইত্যাদি বদলে নতুন দক্ষতা দেয়া যাবে। ওদের একমাত্র ভরসা প্রশিক্ষণ। আমরা তো প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করেই যাচ্ছি। কিন্তু তার ফল তো ভালো না। বিশ্বব্যাংকের টাকা, এডিবির ফান্ড বা সরকারের তহবিল কোনোটারই তো ফলাফল সন্তোষজনক নয়।

বস্তুত ফাহিম যে ডেমোগ্রাফিক ডিজাস্টারের কথা বলেছে সেটি কারো মাথায় ঢুকছে বলে আমি মনে করছি না। আমাদের শিক্ষাবিদ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সরকারের নীতিনির্ধারক বা রাজনীতিবিদদের কেউ এই ভয়ঙ্কর মানববোমাটির কথা ভাবছেই না। লাখ লাখ বেকার থেকে ধীরে ধীরে যখন আমরা কোটি কোটি বেকারের সংখ্যায় উঠছি তখন এই বেকাররাই চাকরির জন্য এত বেপরোয়া হয়ে উঠছে যে তারা যা কিছু করে বসতে পারে। এমনো যদি দেখেন যে কোনো তরুণী তার নিজের সবই কেবল একটি চাকরি পাওয়ার জন্য দিতে চায় তবে অবাক হবেন না। আবার যদি দেখেন যে কোনো বেকার চাকরি না পেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে তাহলেও অবাক হবেন না। যশোরের ৫ অক্টোবরের চিত্রটি সবার চোখে আঙুল দিয়ে এক চরম নির্মম বাস্তবতা তুলে ধরেছে। আমি বেসিসেরই পরিচালক এবং মাইক্রোসফট বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোনিয়া বশির কবিরের ফেসবুক পাতা থেকে এই নবীনদের জন্য কর্মক্ষেত্র কি হতে পারে তার কিছু বিবরণ তুলে ধরছি। সোনিয়ার মতে, তরুণরা যেসব খাতে তাদের পেশা গড়ে তুলতে যেতে পারে সেগুলো হলো ভার্চুয়াল রিয়ালিটি, চিত্র শনাক্তকরণ ও মানচিত্রায়ন, ডিজিটাল নিরাপত্তা, শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তর, ড্রোন, স্মার্ট বাড়িঘর ও কলকারখানা, ইন্টারনেট অব থিংস, ই-কমার্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম ভবিষ্যতের চাকরি সম্পর্কে মন্তব্য করেছে, ‘It is clear from our data that while forecasts vary by industry and region, momentous change is underway and that, ultimately, it is our actions today that will determine whether that change mainly results in massive displacement of workers or the emergence of new opportunities. Without urgent and targeted action today to manage the near-term transition and build a workforce with futureproof skills, governments will have to cope with ever-growing unemployment and inequality, and businesses with a shrinking consumer base. Our dataset aims to bring specificity to the debate and to the options for action, by providing the perspective of Chief Human Resources Officers of leading employers who are among those at the frontline of the emerging trends and are key actors in implementing future workforce strategies. (http://reports.weforum. org/future-of-jobs-2016/employment-trends/)

খুব সঙ্গত কারণেই আমরা এটি উপলব্ধি করতে পারি যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে সর্বোচ্চ প্রত্যয়নপত্র নিয়েও ডিজিটাল যুগের দক্ষতা অর্জন করা যায় না। এমনকি কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরাও ডিজিটাল যুগের জ্ঞান অর্জন করে না। পৃথিবীতে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সূত্র ধরে শিক্ষাব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আসা দরকার ছিল সেটি না আসার ফলে সার্টিফিকেট হাতে চাকরির আবেদনপত্র নিয়ে ঘোরার মানুষের সংখ্যা শিক্ষার হারের পাশাপাশি বাড়ছে।

সেজন্য বেকারের বিদ্যমান স্র্রোত ঠেকাতে এদের দক্ষতা তৈরির পরিকল্পিত ও সমন্বিত আয়োজন করতে হবে। ভবিষ্যতের বেকারের স্র্রোত ঠেকাতে বদলাতে হবে শিক্ষার সবকিছু। উচ্চশিক্ষার দিকে জরুরি নজর দিতে হবে এজন্য যে তারা পেশার জন্য তৈরি হওয়ার পথেই থাকে। যদি শিক্ষার শেষ ধাপেও কোনো দক্ষতা সে না পায় তবে তার হতাশার সূচনা হবে। তবে নজরটা বেশ ভালোভাবে দিতে হবে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্তরেও। আমাদের এখনই ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার দিকে। এই বেকার তৈরির কারখানাটি যদি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে অব্যাহত থাকে তবে আগামী দিনগুলোতে বেকারের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়বে। তখন কি কাজে লাগবে আমার মানবসম্পদ? যে কথাটি সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে বলা দরকার সেটি হলো, এখন আমরা যদি এটি ভাবি যে ছেলেমেয়েদের কেবল কারিগরি বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেব বা এদের কম্পিউটার শেখাব তবে হিসাবটাতে বড় ভুল হবে। এখন সময়টা প্রচলিত কম্পিউটার যুগের নয়। এটি এমনকি কেবল ইন্টারনেটের যুগও নয়। এখন যাদের আমরা তৈরি করতে চাই তারা হোক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রযুক্তির বিশেষজ্ঞ। সৃজনশীল মানবগোষ্ঠী যারা উদ্ভাবন ও গবেষণায় মনোযোগী হবে তেমন প্রজন্ম গড়ে তুলেই ভয়ঙ্কর এই সংকট থেকে আমরা পরিত্রাণ পেতে পারি।

আমার নিজের ভয়টা হচ্ছে যে বিষয়টি আমাদের নীতিনির্ধারকদের নজরে পড়বে না। তারা একে তেমন গুরুত্বও দেবেন না। ফলে যশোরে যেমন ৩০ হাজার আবেদন জমা পড়েছে তেমনটা দেশের সব স্থানেই জমা হবে। একটু ভাবুন তো যশোরের হিসাব যদি ৬৪ জেলাতে হয় তবে আমরা বেকারদের কত বড় একটা বোমার ওপর বসে আছি? কেবল ৩০ হাজার কেন ভাবছি আমরা? বস্তুত সে দিন তো যশোর জেলার সব শিক্ষিত বেকার জমা হয়নি। ৩০ হাজারের বদলে লাখ খানেক আবেদন তো যশোরেই থাকতে পারে। আমি অবিলম্বে এই শিক্ষিত বেকারদের জন্য পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণের আয়োজন করার অনুরোধ করি এবং তাদের ডিজিটাল যুগের দক্ষতা দেয়ার দাবি জানাই।

আমি নিজে এই অবস্থাটি জানি বলেই সেই ১৯৮৭ সাল থেকেই আমি শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরের কথা বলে আসছি। এটাও বলে আসছি যে শিক্ষার পরিবর্তনটা ওপরে যেভাবেই করুন শিশু শ্রেণি থেকেই শুরু করতে হবে। এজন্য ডিজিটাল শিক্ষার শেকড়টা আমি শিশু শ্রেণি থেকেই শুরু করেছি। এই ভাবনা থেকেই আমি শিশুদের প্রোগ্রামার বানানোর লড়াই শুরু করেছি। আসুন আমরা আমাদের শিশুদের জন্য নিজেদের ভবিষ্যৎটাকে উৎসর্গ করি। প্রসঙ্গত যারা যশোরে চাকরি মেলার আয়োজন করেছিলেন তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এই বলে যে তথ্যপ্রযুক্তির আবেদন জমা দেয়ার জন্য কাগজের দরখাস্ত ও কাগজের খাম নেয়ার দরকার ছিল না। তথ্যপ্রযুক্তির চাকরির আবেদন অনলাইনে হতে পারত এবং অনলাইনের জীবনবৃত্তান্ত থেকে বাছাই করে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা যেত। ডিজিটাল যুগে বাস করে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ অ্যানালগ পদ্ধতি ব্যবহার করুক সেটি আমরা চাই না। তাদের ডিজিটাল রূপান্তরটা আমাদের কাম্য।

ঢাকা, ২৮ অক্টোবর ১৭ মোস্তাফা জব্বার : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App