×

মুক্তচিন্তা

‘সীমান্তরেখা’ : জীবন ও ইতিহাসে অবগাহন

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:১৯ পিএম

চেতনায় প্রত্যাশা

গতকাল প্রকাশের পর প্রসঙ্গত বলি, পূর্ববাংলার হিন্দু তপসিল সম্প্রদায় সীমান্তরেখা সৃষ্টির আগে আগে মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে এই বিভেদরেখা কেন সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিয়েও গবেষণা ও আলোচনা হয়েছে খুবই কম। আমি যখন ‘ষাটের দশকের গণজাগরণ’ বইটি লিখি, তখন পাক-ভারত বিভক্তির সময় তপসিল সম্প্রদায়ের ভূমিকা কী ছিল, তা অনুসন্ধান করতে সচেষ্ট ছিলাম। খুঁজতে খুঁজতে গোপালগঞ্জের গ্রামাঞ্চল থেকে তখনকার একটি  স্লোগান জানতে পারি। এটি হলো ‘আইলে আইলে ভাই ভাই/সবাই মিলে পাকিস্তান চাই।’ আসলে এটাই ছিল নির্যাতিত শোষিত মুসলিম ও তপসিল হিন্দু কৃষকদের বর্ণপ্রথার কবলে নিপতিত জাতীয় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সম্মিলিত অবস্থান। পরে পাকিস্তান সৃষ্টি হলে মুসলিম লীগের ‘শির কুচল দেঙ্গে’ ধরনের আক্রমণ থেকে হিন্দু বিধায় তপসিল সম্প্রদায়ের মানুষরাও রেহাই পায়নি। ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিম্নস্তরের মানুষ, যারা পাকিস্তান জন্মের পক্ষে ছিল কেবল তাদের নয়, নেতাদের কারো কারো বর্ডারের অপর পাড়ে বাধ্য হয়ে চলে যেতে হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এটা কি ছিল মুসলিম সম্প্রদায় ও হিন্দু সম্প্রদায়ের অবহেলিত শোষিত-নিপীড়ত কৃষক সম্প্রদায়ের মিলনের কোনো ইঙ্গিত? যা পাকিস্তানের শাসক-শোষকগোষ্ঠী চরম এক বিয়োগান্তক ঘটনাবলির ভেতর দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিল! ক্ষুদ্র এ কলামে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বৃথা। প্রামাণ্যচিত্রে তানভীর এই দিকটিকে বিবেচনার মধ্যে নেয়নি। তাতে অবশ্য প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের সাফল্য একটুও স্লান হয়নি।

আরো দুটো শিক্ষার কথা এখানে না বললেই নয়। প্রথমত, আমরা যখন স্কুলে পড়ি, তখন হঠাৎ করেই একদিন স্কুলে গিয়ে শুনি, হিন্দু হোস্টেলের সুপারিনটেন্ডেন্ট স্যার কাউকে কিছু না জানিয়ে পরিবারসহ ভারতে চলে গেছেন। বিষয়টা তখনকার মতো শহরকে বেশ আলোড়িত করেছিল। পরে এক সময় শুনেছিলাম, ভারতের আসামে বাঙালি খেদাও আন্দোলনে অসমিয়া ঘাতকদের নিষ্ঠুর আঘাতে আমাদের ওই প্রিয় স্যার সপরিবারে জীবন দিয়েছেন। দেশভাগ নিয়ে যখন ভাবি, তখন কেন জানি না, এই কথাটি আমার মনে পড়বেই। আসলে দেয়াল কখন কোথায় কীভাবে তৈরি হবে, তা কেউ বলতে পারবেন না। সংকীর্ণতা ও অমানবিকতা দেশ কাল পাত্র নির্ভর নয়। বিশ্বের সর্বত্র যেমন রয়েছে অশুভ বিভেদ ও অন্ধকারের শক্তি তেমনি রয়েছে শুভ সম্প্রীতি ও প্রগতির শক্তি। শুভ আর অশুভের সংগ্রামের ভেতর দিয়ে সভ্যতার জয় তোরণ রচিত হয়। এই চির সত্য কথাটা ‘সীমান্তরেখা’ প্রামাণ্যচিত্রে কোনো না কোনোভাবে তুলে ধরলে ভালো হতো বলে মনে হয়। নতুবা মনে হতে পারে, আমরা হতভাগ্য বাঙালিরাই কেবল বাস্তবে ও মননে ভাইয়ে ভাইয়ে হিংসা-দ্বেষ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে সীমান্তরেখা সৃষ্টি করেছি।

দ্বিতীয় ঘটনা ১৯৬১ সালে, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালন করা নিয়ে। অনুষ্ঠান করা নিয়ে আইয়ুব খানের সামরিক সরকারের আপত্তি শুরু হলো। ছাত্রদের সাম্প্রদায়িক অংশ কোনোক্রমেই স্কুলে অনুষ্ঠান করতে দিবে না। রহিম স্যার দৃঢ়ভাবে দাঁড়ালেন স্কুলের ট্র্যাডিশনের পক্ষে। ধর্মীয় অনুশাসন কঠোরভাবে পালন করা সত্তে¡ও তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও রবীন্দ্র ভক্ত। কলকাতায় ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি শান্তি নিকেতন গিয়েছিলেন। তখন কবিগুরু মাথায় হাত দিয়ে স্যারের কল্যাণ কামনা করেছিলেন। রহিম স্যারের তৎপরতায় স্যারদের মধ্যেও বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে উঠল। চরম সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা। মারামারি হাতাহাতির উপক্রম। এমন পরিস্থিতিতে রহিম স্যার হেডমাস্টার সাহেবের কাছে গিয়ে বললেন, সরকারের কি লিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে? লিখিত কিছু ছিল না। বিলাত ফেরত হেড স্যারও রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের পক্ষে ছিলেন। সিদ্ধান্ত হলো পালনের পক্ষে। কিন্তু উগ্রবাদী ছাত্রদের হুমকি-ধামকিতে কোনো ছাত্র অনুষ্ঠানে অংশ নিতে চায় না। রহিম স্যার বেত নিয়ে বের হয়ে নবম শ্রেণিতে আসলেন। উগ্রবাদীদের কিছু বললেন না। বরং ভয়ে অনুষ্ঠানে অংশ যারা নিতে চায় না, তাদের কয়েকজনকে বেত্রাঘাত করলেন। আমার পিঠেও পড়ল দুই-এক ঘা। পরে মহাসাড়ম্বরে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালিত হলো। উল্লিখিত ঘটনা জীবনের গতিপথে এই শিক্ষাই রেখে গেছে, মানবতার পক্ষে অবস্থান গ্রহণের জন্য প্রয়োজনে মাঝে মাঝে সমাজকে ঝাঁকুনি দিতে হয়। জানি না! তানভীর মোকাম্মেলের এই প্রামাণ্যচিত্রটি মানবতা, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের পক্ষে সর্বৈবভাবে অবস্থান গ্রহণের জন্য রহিম স্যারের বেতের মতো জাতিকে কোনো ঝাঁকুনি দিবে কিনা? শেষ

শেখর দত্ত : রাজনীতিক, কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App