×

মুক্তচিন্তা

হারিয়ে যাওয়া সাংবাদিক এবং রাবির চারুকলা অনুষদ

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০১৭, ০৭:৫৩ পিএম

মিডিয়া কর্তৃপক্ষ দাবি করে, উৎপলকে সুস্থ অবস্থায় ফেরত চাই। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে ওর বোনের আহাজারি, ‘উৎপল, তুই কই? ফিরে আয়’- সবাইকে কাঁদিয়েছে। উৎপল কি গুম হয়েছে? গুম-খুন বাংলাদেশে অতি পরিচিত শব্দ। মুক্তিপণ আদায়ে গুম বহুল ব্যবহৃত কৌশল। কখনো কখনো খুন। উৎপলের ভাগ্যে কী ঘটেছে কে জানে? আমরা আশা করি উৎপল ফিরে আসবে। তাই আসুক।

দুটি ডিস্টার্বিং নিউজ। প্রথমটি একজন সাংবাদিকের হারিয়ে যাওয়া। অন্যটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। আরো আছে, বৃহস্পতিবার ২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ঘটনার বর্ষপূর্তি। মামলা এখনো আদালতে ওঠেনি। অভিযুক্তরা সবাই জামিনে বহাল তবিয়তে আছে। এর মধ্যে ভালো সংবাদ হলো- পাকিস্তানিদের ভেঙে দেয়া রমনা কালীবাড়িটি ভারত নির্মাণ করে দেবে। আমরা পারলাম না, ভারতকেই তা করতে হলো? তবুও বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ। ধারণা করি বাংলাদেশের হিন্দুরা যথাস্থানে, আগের মতো পুকুরসহ পুরো জমি এবং আধুনিক মন্দির ও সারদা মায়ের আশ্রম ফিরে পেতে যাচ্ছে। এর ফলে হিন্দুদের একটি দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হবে। মন্দিরটি এমনভাবে নির্মিত হোক যাতে বিশ্বের হিন্দুরা এটি দর্শনে ভিড় জমায় এবং বাংলাদেশ এ থেকে পর্যটন শিল্পে যথেষ্ট আয় করতে সক্ষম হয়। সরকার একই সঙ্গে ঢাকেশ্বরী মন্দিরকে ‘জাতীয় মন্দির’ ঘোষণা করতে পারেন। এটি এমনিতে জাতীয় মন্দির হিসেবে পরিচিত, এমনকি প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাও এটিকে জাতীয় মন্দির হিসেবে অভিহিত করেন, কিন্তু কাগজে-কলমে মন্দিরটি তা নয়। ঢাকেশ্বরী থেকে ঢাকা অথবা ঢাকা থেকে ঢাকেশ্বরী, দুটির সম্পর্ক নিবিড়। তাই ঢাকেশ্বরী হোক জাতীয় মন্দির।

সাংবাদিক নিখোঁজ সংবাদটি দুঃসংবাদ। ১০ অক্টোবর পূর্বপশ্চিমবিডি ডট নিউজের সাংবাদিক উৎপল দাস প্রকাশ্য দিবালোকে হারিয়ে যায়। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ নেই? পুলিশ-র‌্যাব কেউ কিচ্ছু জানে না। উৎপল বেমালুম উধাও। তার সেলফোন এত দিন বন্ধ ছিল। হঠাৎ ওটা ক’দিন আগে সচল হয়। অপরপক্ষ থেকে মুক্তিপণ চাওয়া হয়! মিডিয়া কর্তৃপক্ষ এগিয়ে এসেছেন। তারা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। প্রধান সম্পাদক পীর হাবিবুর রহমান বলেছেন, উৎপল ফিরে আসুক মায়ের কোলে, আমাদের মাঝে। মিডিয়া কর্তৃপক্ষ দাবি করে, উৎপলকে সুস্থ অবস্থায় ফেরত চাই। সংবাদ সম্মেলনে ওর বোনের আহাজারি, ‘উৎপল, তুই কই? ফিরে আয়’- সবাইকে কাঁদিয়েছে। উৎপল কি গুম হয়েছে? গুম-খুন বাংলাদেশে অতি পরিচিত শব্দ। মুক্তিপণ আদায়ে গুম বহুল ব্যবহৃত কৌশল। কখনো কখনো খুন। উৎপলের ভাগ্যে কী ঘটেছে কে জানে? আমরা আশা করি উৎপল ফিরে আসবে। তাই আসুক।

দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি হচ্ছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। চারুকলা বিভাগ সচরাচর সব কুসংস্কারমুক্ত সৃজনশীল হয়ে থাকে। কিন্তু রাজশাহী ভার্সিটির চারুকলার সৃজনশীলতার নমুনা কি এই? ভর্তি পরীক্ষায় তাদের প্রশ্নমালার কিছু অংশ আপত্তিকর, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, বিদ্বেষপ্রসূত এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন। মূলত দুটি প্রশ্ন নিয়ে আপত্তি উঠেছে। প্রথম প্রশ্নটি হচ্ছে- মুসলমান রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়নামারের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সশস্ত্র হামলা চালায় কত তারিখে? প্রশ্নটি ভুল ও অসৎ। ভুল এ কারণে যে, রোহিঙ্গা সম্প্রদায় শুধু একটি ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে গঠিত নয়! তদুপরি প্রশ্নের মধ্যে দুটি ধর্মীয় সম্প্রদায়, মুসলমান ও বৌদ্ধদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়ার একটি অপপ্রয়াস লক্ষণীয়। আকার-ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, বৌদ্ধরা মুসলমানদের হত্যা করছে। এটা ভেদবুদ্ধি এবং উসকানি। ভাবতে অবাক লাগে, চারুকলা অনুষদে এমন শিক্ষকও আছেন? যে অনুষদ সংস্কৃতিনির্ভর, সেখানেই এতটা অপসংস্কৃতি?

প্রশ্নপত্রের অপর প্রশ্নটি আরো আপত্তিকর এবং অগ্রহণযোগ্য। সেটি হচ্ছে- পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ কোনটি? উত্তরে চয়েস দেয়া আছে ৪টি। যথাক্রমে তা হলো- পবিত্র কুরআন শরিফ, পবিত্র ইঞ্জিল শরিফ, পবিত্র বাইবেল ও গীতা। ধারণা করি, দুটি প্রশ্ন একই ব্যক্তি করেছেন এবং তিনি বৌদ্ধদের ওপর বিরক্ত, তাই ত্রিপিটক বাদ পড়েছে। হিন্দুদের ওপরও প্রশ্নকর্তার যথেষ্ট বিদ্বেষ আছে, তাই গীতার আগে তিনি পবিত্র লেখেননি। এতে অবশ্য হিন্দুদের কিছু যায়-আসে না, কিন্তু বিষয়টি দৃষ্টিকটু? আবার পবিত্র ও শরিফ দুটি সমার্থক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, অথচ যা পবিত্র তাই শরিফ, অথবা যা শরিফ তাই পবিত্র। দুটি শব্দ দুটি ভাষা থেকে এসেছে, কিন্তু অর্থ এক? এটাকে অনেকটা, ‘গাড়ি পেছন দিকে ব্যাক করছে’ বাক্যের মতো শোনায়! তবে কেউ যদি বলেন যে, বেশি পবিত্র বোঝাতে ‘পবিত্র ও শরিফ’ একত্রে ব্যবহৃত হয়েছে, তবে সেটা ভিন্ন কথা! একটি গল্প মনে এলো- এক ছাত্র শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করল, ‘স্যার, পিলার লিখতে একটা ‘এল’ নাকি দুটো’? শিক্ষক কনফিউজড, বললেন, একটা এল দিলে চলে, কিন্তু দুটি দিলে পিলারটি পোক্ত হয়।

মূলত চারুকলা বিভাগের প্রশ্নে ধর্মানুভ‚তিতে আঘাত দেয়া হয়েছে। কারণ এর উত্তর আপেক্ষিক। তদুপরি, এটি কোনো প্রশ্নই না! সুখের বিষয়, ছাত্ররা এর প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে, হুমকি দিয়েছে বৃহত্তর আন্দোলনের। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মিটিং করেছেন, তারা বলেছেন, ব্যবস্থা নেবেন। চারুকলা অনুষদ হচ্ছে সাংস্কৃতিক পীঠস্থান। এই বিভাগের অবস্থা এমন হলে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা কী? দেশের একটি সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যদি এই দুরবস্থা হয়, তাহলে নিচের তলায় কী হচ্ছে?

ইতোপূর্বে শিক্ষা ব্যবস্থার ‘হেফাজতিকরণ’ হয়েছে। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকের মান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে কে জানে? আচ্ছা, ৫৭-ধারা কি ওইসব প্রশ্নমালার জন্য প্রযোজ্য? ভেবে অবাক লাগে, কোথায় যাচ্ছে দেশ? মনে হয়, ‘এক অদ্ভুত উটের পিঠে চলছে স্বদেশ?’ এর মধ্যে দেখলাম, নীলফামারী সদর উপজেলাধীন প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর পঞ্চম শ্রেণির মডেল টেস্ট ২০১৭-এর একটি প্রশ্নে বলা হচ্ছে- তোমার পাড়ার একজন লোক মারা গিয়েছে। তোমরা অবশ্যই সবাই মিলে কবরে দাফন করলে। সে কোথায় যাবে? উত্তরে চয়েস দেয়া আছে- জাহান্নামে, দোযখে, নরকে ও বৃন্দাবনে। প্রথমত, প্রশ্নকর্তা সম্মানীয় শিক্ষক একজন মৃতকে সম্মান দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, বাক্যটি ‘মারা গিয়েছে’ হবে না, সঠিক বাক্যটি হবে ‘মারা গিয়েছেন’। দ্বিতীয়ত- বৃন্দাবন একটি শহর, বাকি তিনটি চয়েসের মতো কাল্পনিক নয়? মোদ্দা কথা হচ্ছে, প্রশ্নের মধ্যেই প্রশ্নকর্তার সীমাবদ্ধ জ্ঞানের আভাস মেলে।

নিউইয়র্ক থেকে শিতাংশু গুহ : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App